মিয়ানমারের ওপর চাপ দিন: প্রধানমন্ত্রী

রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করে তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর আইনপ্রণেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেছেন, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সাময়িকভাবে আমরা এই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা নাগরিককে আশ্রয় দিয়েছি। আপনাদের অনুরোধ জানাব, রোহিঙ্গা ইস্যুটি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করুন। মিয়ানমারকে তার নাগরিকদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করতে এবং বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চাপ প্রয়োগ করুন।
জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় রোববার ৬৩তম কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি কনফারেন্সের (সিপিসি) উদ্বোধন ঘোষণা করে এসব কথা বলেন সিপিএর (কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশন) ভাইস প্যাট্রন ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম সংসদীয় ফোরাম কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের ৫২টি দেশের মধ্যে ৪৪টি দেশ, ১৮০টি শাখার মধ্যে ১১৪টি শাখা এবারের সম্মেলনে অংশ নিচ্ছে। এসব দেশের জাতীয় এবং প্রাদেশিক সংসদের ৫৬ জন স্পিকার, ২৩ জন ডেপুটি স্পিকার এবং সংসদ সদস্যসহ প্রায় ৫৫০ প্রতিনিধি এ সম্মেলন উপলক্ষে অবস্থান করছেন ঢাকায়।
এবারের সম্মেলনের প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে ‘কনটিনিউনিং টু এনহ্যান্স হাই স্ট্যান্ডার্ডস অফ পারফরমেন্স অব পার্লামন্টোরিয়ানস’।
সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা সঙ্কটের প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর অমানবিক নির্যাতন এবং তাদের জোর করে বিতাড়িত করার ঘটনা কেবল এ অঞ্চলে নয়, এর বাইরেও অস্থিরতা তৈরি করছে।
মিয়ানমার সরকারের এই আচরণের ফলে গত ২৫ আগস্ট থেকে ছয় লাখ ২২ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ১৯৭৮ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে আসা আরও প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে।
বাংলাদেশ বরাবরই বলে আসছে, রোহিঙ্গা সমস্যার পেছনে বাংলাদেশের কোনো ভূমিকা নেই; সমস্যার সৃষ্টি এবং কেন্দ্রবিন্দু মিয়ানমারে, সমাধানও সেখানে নিহিত।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’- এই নীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি পরিচালিত হয়। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের লক্ষ্যে তার সরকার সব সময়ই কাজ করে যাচ্ছে।এর ফলে আমরা ভারতের সঙ্গে গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি এবং স্থল সীমানা চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের বিরোধের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি করতে পেরেছি। একইভাবে মিয়ানমার এবং ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়েছে।
সিপিসি’র মতো আন্তর্জাতিক সম্মেলন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও চর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে মন্তব্য করে অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমাদের প্রথম ও প্রধান নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে গণতন্ত্র এবং সংসদীয় গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও প্রতিষ্ঠানকে আরও শক্তিশালী করা এবং এসব রীতিনীতি ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনগণের পূর্ণ আস্থা তৈরি করা।’
এ সময় শেখ হাসিনা বলেন, ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আমার দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী নির্যাতনের শিকার হওয়া সত্ত্বেও আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থেকে বিচ্যুত হইনি। আমরা মনে করি, একমাত্র গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাই মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো ভালোভাবে পূরণ করে উন্নত জীবন নিশ্চিত করতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ভিত শক্তিশালী করার মাধ্যমে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা। সেলক্ষ্যে আমরা রূপকল্প-২০২১ প্রণয়ন করি। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ভিত্তিতে আমরা আমাদের কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।’
জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের ফলে বাংলাদেশ যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে, সে কথাও অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, এ বছর অতিবৃষ্টিসহ কয়েকবার বন্যায় আমাদের বিশাল জনপদ ভেসে গেছে। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে ফসলের। তিনি জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে, তা দ্রুত ছাড় করা হবে বলেও প্রত্যাশা করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে একটি দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তুলতে সরকার নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অতন্ত্র প্রহরী স্বাধীন এবং শক্তিশালী গণমাধ্যম। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়েছে। নিশ্চিত করা হয়েছে তাদের অবাধ স্বাধীনতা। মানুষের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।
রোববার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হলেও এবারের কনফারেন্সের কার্যক্রম শুরু হয়েছে গত ১ নভেম্বর। ঢাকার হোটেল র্যাডিসনে ২ থেকে ৪ নভেম্বর সিপিএর বিভিন্ন অঞ্চল, কমনওয়েলথ উইমেন পার্লামেন্টারিয়ানস এবং নির্বাহী কমিটিসহ বিভিন্ন কমিটির বৈঠক হয়।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রেই সম্মেলনের সাধারণ সভা, বিভিন্ন গ্রুপের মিটিং ও আটটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হবে। সিপিএ’র নতুন চেয়ারপারসনও নির্বাচিত করা হবে এ সম্মেলনে।
১৯১১ সালে সিপিএ’র যাত্রা শুরু হয়। আফ্রিকা, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল, কানাডা, ক্যারিবিয়ান আমেরিকা ও আটলান্টিক, ভারত, প্যাসিফিক ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া- এই নয়টি অঞ্চল নিয়ে সিপিএ গঠিত।বাংলাদেশ এ ফোরামের সদস্য পদ পায় ১৯৭৩ সালে।
সিপিএর ৬২তম সম্মেলন গত বছর সেপ্টেম্বরে ঢাকায় হওয়ার কথা থাকলেও জুলাই মাসে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার কারণে তা আর হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনের উদ্বোধন ঘোষণার পর বিশেষ ডাকটিকিট ও খাম অবমুক্ত করেন।
এর আগে শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছালে ঘণ্টা বাজিয়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু হয়। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের পর ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করা হয়। এরপর ‘আলোকের এই ঝর্ণা ধারায় ধুইয়ে দাও’ এবং ‘আমার মুক্তির আলোয়’ গান দুটির সঙ্গে উদ্বোধনী নৃত্য পরিবেশন করেন নৃত্যাঞ্চলের শিল্পীরা।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন সিপিএ-এর চেয়ারপারসন এবং বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। পরে তিনি এই ফোরামের প্যাট্রন ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান।
ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর স্বাগত বক্তব্যের পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামী জীবন এবং সিপিএ’র কার্যক্রম নিয়ে দুটি তথ্যচিত্র দেখানো হয়।
দুই তথ্যচিত্রের মাঝে নাচের দল নৃত্যাঞ্চল দলগত নৃত্য পরিবেশন করে। সিপিএ মহাসচিব আকবর খান অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন। পরে ‘বাংলাদেশ দ্যা গোল্ডেন ডেল্ট’ শীর্ষক নৃত্যনাট্য পরিবেশিত হয়। এছাড়া ‘সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি তথ্যচিত্রও দেখানো হয় অনুষ্ঠানে।