সিলেট ও মৌলভীবাজারে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি

0
beanibazar-1-loka--01--07--_304324

beanibazar-1-loka--01--07--_304324

দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অনেক জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। শনিবার পর্যন্ত সিলেটে উঁচু এলাকায় পানি না বাড়লেও নতুন করে প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চল। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার মানুষ। বালাগঞ্জে গোখাদ্যের সংকটসহ বৃদ্ধি পাচ্ছে পানিবাহিত রোগ। অনেক স্থানে রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় ভেঙে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা; স্থবির হয়ে পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য। মৌলভীবাজারে পানি ওঠায় ৮৭টি স্কুলে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। রংপুরে তিস্তার পানি বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। লালমনিরহাটের হাতিবান্ধায় বাঁধ ভেঙে পুরো একটি গ্রাম প্লাবিত হয়ে গেছে।

সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে, গোখাদ্যের সংকটসহ পানিবাহিত রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। টানা বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কুশিয়ারার পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উপজেলার প্রায় দুই শতাধিক গ্রামের দেড় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। উপজেলা হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শহরের আবাসিক এলাকা পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। নির্মাণাধীন বালাগঞ্জ-খসরুপুর সড়কের ওপর দিয়েও লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। পানির তোড়ে এই সড়কের বালাগঞ্জ থেকে রাধাকোনা অংশের দুটি স্থানে ৩০-৪০ ফুট করে ভেঙে যাওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সড়কের অন্যান্য অংশ এভাবে ভেঙে গিয়ে বন্যার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। চাহিদা অনুযায়ী ত্রাণ অপ্রতুল। এ ছাড়া বেসরকারিভাবে ত্রাণসামগ্রী বিতরণও তেমন একটা নেই। ফলে মানবেতর জীবনযাপন করছেন পানিবন্দি মানুষ।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রদীপ সিংহ জানান, পানিবন্দি হয়ে লোকজন দুর্ভোগে রয়েছেন। সরকারিভাবে প্রথমে ৫ টন এবং পরবর্তী সময়ে আরও ১২ টন চাল ও নগদ ২১ হাজার ৫০০ টাকা বরাদ্দ এসেছে। সেগুলো ৬টি ইউনিয়নে বণ্টন করা হয়েছে। শনিবার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদাল মিয়া ব্যক্তিগতভাবে বন্যাকবলিত বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে নগদ অর্থ প্রদান করেছেন। এ ছাড়া রাধাকোনা গ্রামের ৩০টি পরিবারের মাঝে উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তুহিন মনসুর ১০ কেজি করে চাল প্রদান করেন।

জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ৮০ হাজারেরও বেশি মানুষ। উপজেলা সদরের প্রধান সড়কসহ বেশিরভাগ সড়কই ৩-৪ ফুট পানির নিচে। ভেঙে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। ইতিমধ্যে ফেঞ্চুগঞ্জ বাজারের ৪ শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। বেশিরভাগ মৎস্য খামার ও জমির ফসল তলিয়ে গেছে। গবাদিপশু, হাস-মুরগি, শিশু ও বৃদ্ধদের নিয়ে মহাবিপাকে পড়েছেন বন্যাকবলিত মানুষ। ফেঞ্চুগঞ্জের ইউএনও হুরে জান্নাত জানান, বন্যার্তদের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। সিলেট জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে নগদ টাকা ও পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।

গতকাল নতুন করে বিয়ানীবাজার পৌরসভা, মুড়িয়া, লাউতা, মাথিউরা, তিলপাড়া ইউনিয়নসহ বেশ কিছু এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। ফলে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।

শনিবার পর্যন্ত দুটি আশ্রয় কেন্দ্রে ২৫টি পরিবারের আশ্রয় নেওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বিয়ানীবাজার-চন্দরপুর-সিলেট সড়কের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় চতুর্থ দিনের মতো কোনো যান চলাচল করেনি। সড়কের মধ্যে সবচেয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে তিলপাড়া বাজার এলাকায়। শনিবার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সাড়ে ১৪ টন ত্রাণ দুর্গত এলাকায় বিতরণ করা হয়েছে।

জেলার ওসমানীনগর উপজেলায় ৮টি ইউনিয়ন- সাদীপুর, পশ্চিম পৈলনপুর, বুরুঙ্গা, উমরপুর, উছমানপুর, গোয়ালাবাজার, তাজপুর ও দয়ামীর নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। বন্যাদুর্গত এলাকা সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ে রাখতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইউএনও কার্যালয়ে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ও বিভিন্ন তথ্য প্রদানের জন্য সর্বসাধারণের জন্য একটি জরুরি ০১৯২৯৩৩৬৬২৯ মোবাইল নম্বর রাখা হয়েছে। ওই নম্বরে ফোন করে বন্যাদুর্গত এলাকার যে কোনো তথ্য সরবরাহের অনুরোধ করা হয়েছে।

মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলায় ১২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ৭৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি ওঠায় পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে।

মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রোজার ছুটির পর গতকালই ছিল স্কুল খোলার প্রথম দিন। তবে উপজেলার হাকালুকি হাওর পারের স্কুলগুলোতে পানি ওঠায় শিক্ষা কার্যক্রম চালানো সম্ভব হয়নি।

পশ্চিম বর্নি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল চন্দ্র সিংহ বলেন, ‘স্কুলে পানি উঠেছে। পার্শ্ববর্তী এলাকার রাস্তাঘাটও পানির নিচে।’ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সমীর কান্তি দেব বলেন, ‘স্কুলঘরে পানি ঢুকে পড়েছে। ছাত্র-শিক্ষক কারও আসার উপায় নেই। দুটি পরীক্ষার তারিখ পেছানো হয়েছে।’

এদিকে রংপুরে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে তিস্তা অববাহিকায় চরগ্রামগুলোতে পানি উঠেছে। শনিবার সকাল ৬টায় ডালিয়া পয়েন্টে পানির প্রবাহ ছিল ৫২ দশমিক ৫০ সেন্টিমিটার। এ পয়েন্টে বিপদসীমা ধরা হয় ৫২ দশমিক ৪০ মিটার। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। চলতি বর্ষা মৌসুমে তিস্তা নদীর পানিপ্রবাহ এই প্রথম বিপদসীমা অতিক্রম করল। গঙ্গাচড়ায় তিস্তার ভাঙনে মার্জিনাল ডাইক বাঁধে ফাটল দেখা দেওয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অর্ধশতাধিক বাড়িঘর।

কোলকোন্দ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেন রাজু জানান, তিস্তার পানি বেড়ে যাওয়ায় গঙ্গাচড়া উপজেলার তিস্তা নদীবেষ্টিত নিচু চরগুলোতে পানি উঠে পড়েছে। এর মধ্যে পাইকান এলকায় কয়েক বিঘা আবাদি জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। রংপুর পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী তৌহিদুর রহমান ভাঙনের কথা স্বীকার করে বলেন, ভাঙন রোধে জরুরি ভিত্তিতে জিও ব্যাগ ফেলা হবে।

পাউবোর ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ভারি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে তিস্তার পানি বেড়েছে। পানির প্রবাহ আরও বাড়তে পারে।

লালমনিরহাটেও একই অবস্থা। সেখানে তিস্তার পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শনিবার সকালে হাতিবান্ধার তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। উজানের ঢলে হঠাৎ পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় তিস্তা ব্যারাজের তিন কিলোমিটার ভাটিতে হাতিবান্ধার ধুবনি গ্রামের দুটি অংশের বাঁধ ভেঙে গেছে। এতে দুই শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। উপজেলার সিংঙ্গীমারী ইউপি চেয়ারম্যান মনোয়ার হোসেন দুলু জানান, তার ইউনিয়নে দুটি স্থানে বাঁধ ভেঙে প্রায় ৭০০ পরিবার পানিবন্দি হয়েছিল।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *