অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনই একমাত্র লক্ষ্য :প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আগামী নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত করাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। গতকাল শনিবার রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ ও উপদেষ্টা পরিষদের যৌথসভায় প্রধানমন্ত্রী একথা বলেন। তিনি আরো বলেন, দেশে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে এবং জনগণের ভোটের সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে বার বার জীবনের ঝুঁকি নিয়েছি। তাই গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়াই আওয়ামী লীগের লক্ষ্য। ভবিষ্যতে জনগণের ভোটের মৌলিক অধিকার কেউ যাতে কেড়ে নিতে না পারে সেটাই আমরা চাই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের পরিচালনায় সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় যৌথসভাটি শুরু হয়। সভায় শোক প্রস্তাব গ্রহণ ছাড়াও ৩ নভেম্বর জেলহত্যা দিবস, ১০ নভেম্বর শহীদ নূর হোসেন দিবসসহ কয়েকটি দিবসের দলীয় কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হয়। বৈঠকে আগামী ১৮ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংলাপে দলীয় প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হয়।
যৌথসভায় সূচনা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী ইলেকট্রনিক ভোটিং সিস্টেমের (ই-ভোটিং) পক্ষে তাঁর দলের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ওয়ান ইলেভেনের সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমি দেশে ফিরে না আসলে নির্বাচন হতো না, দেশে গণতন্ত্রও ফিরে আসতো না। তাই আমরা সবসময়ই চাই নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হোক। যাতে দেশের জনগণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে তাঁদের ভোটের অধিকার প্রয়োগ করতে পারে। জনগণ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমরা দেশকে সবদিক থেকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি। সারা পৃথিবীর সামনে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোলমডেল। সারাবিশ্বে বাংলাদেশ এখন সম্মানজনক অবস্থানে উঠে এসেছে। সরকারের ধারাবাহিকতা না থাকলে দেশে এতো উন্নয়ন ও অগ্রগতি সম্ভব হতো না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সামরিক শাসনের সময় বিচার বিভাগ, প্রশাসন ও সংসদকে কুক্ষিগত করা হয়। সামরিক ফরমান দিয়ে বারবার বয়সসীমা কমিয়ে বিচারপতিদের বিদায় জানানো হয়। এজলাসে থাকা অবস্থায় একজন প্রধান বিচারপতিকে জানানো হয় উনি আর ওই পদে নেই। প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধী, স্বাধীনতাবিরোধী ও বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের সংসদে বসানো হয়, তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় লাখো শহীদের রক্তস্নাত জাতীয় পতাকা। দুর্নীতিকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এরপর আমরা দেখলাম একবার প্রধান বিচারপতির বয়স ৬২ থেকে ৬৫ আবার ৬৫ থেকে ৬২ তে আনা হলো। যিনি কেবলমাত্র অবসরপ্রাপ্ত হয়েছেন, ভোটচুরির জন্য প্রধান উপদেষ্টা করার জন্য বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পাদক প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে প্রধান উপদেষ্টা বানানো হলো। চক্রান্ত করলো যাতে তিনি প্রধান উপদেষ্টা হয়ে ভোট চুরির সুযোগ করে দেন।
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ৭৫ পরবর্তী দীর্ঘ ২১ বছরে নির্বাচনের নামে প্রহসন এবং জনগণের ভোটের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর শুরু হয় হত্যাকান্ড ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। উর্দি পড়ে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে জিয়াউর রহমান শুরু করেন নির্বাচনের নামে প্রহসন। হ্যাঁ-না ভোট বা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের নামে জনগণের ভোটের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে। তখন থেকেই মূলত নির্বাচনের নামে দেশে প্রহসন শুরু হয়। জিয়াউর রহমানের পর এরশাদ সরকারের আমলেও একই প্রহসন চলে।
তিনি বলেন, ’৯০ দশকে আন্দোলন করে আমরা গণতন্ত্র ফিরে আনলেও খালেদা জিয়ার শাসনামলেও জনগণের ভোটের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচন করায় দেশের জনগণ খালেদা জিয়াকে দেড় মাসও ক্ষমতায় থাকতে দেয়নি। আন্দোলনের মুখে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মহাজোট গঠন করে আমরাই প্রথম নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানে ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা ও স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের দাবি জানিয়েছিলাম। তা পরবর্তীতে নিশ্চিত করা হয়। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন কমিশন সংলাপ করছেন। আমরাও তাতে অংশ নেব। নির্বাচন কমিশনের কাছে দেওয়া প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। আলোচনা করে তা চূড়ান্ত করা হবে। আমরা তা নির্বাচন কমিশনের কাছে তুলে ধরব।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ’৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর আমরা যতজন বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছিলাম বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে তাঁদের মধ্যে ১০ জন বিচারপতিকে স্থায়ী না করে সরানো হয়। পরে আরও ৬ জনকে সরানো হয়। পরে অবশ্য কয়েকজন রিট করে ওই পদে ফিরে এসেছেন। নির্বাচনে কারচুপি করতে প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানের বয়স বাড়ানো হয়, তিনি ওই দলটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। এক কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোটের দুর্নীতি, দুঃশাসন, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ সৃষ্টির কারণে ওয়ান ইলেভেন আসে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে ক্ষমতায় যারা আসেন তারা নির্বাচন না দিয়ে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার চেষ্টা করেন। বিদেশে থাকা অবস্থায় আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হয়। অসুস্থ নাতি, ছেলের বউসহ সবাইকে ফেলে মামলা মোকাবেলার জন্য দেশে ফিরে আসতে চাইলে আমাকে বাধা দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বার বার সংগ্রাম করেছি। ওই সময় দেশে ফিরলে আমাকে জীবননাশেরও হুমকি দেওয়া হয়। কিন্তু আমি মৃত্যুকে কখনো ভয় করি না। যতক্ষণ শ্বাস আছে ততক্ষণ গণতন্ত্রের জন্য কথা বলেই যাব। অনেকেই বলেছিল মামলা হলে দেশ ছেড়ে পালাই। আমি বলেছি আমি কখনো কোনো অন্যায় করিনি, আমি পালাব কেন? আমি দেশে ফিরেই মিথ্যা মামলা মোকাবেলা করবো। অনেক বাধা ডিঙ্গিয়ে আমি দেশে ফিরে আসলে বিনা ওয়ারেন্টে আমাকে গ্রেফতার করে একের পর এক মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। কোন সার্চ ওয়ারেন্ট ছাড়াই আমার বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়। তিনি বলেন, ওই সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশে ফিরে না আসলে দেশে নির্বাচনও হতো না, গণতন্ত্রও থাকতো না। রাজনীতি নিজের জন্য নয়, রাজনীতি করি জনগণের সেবা ও কল্যাণের জন্য।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্বাচনে খালেদা জিয়াকে আনতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। নিজে তাঁকে ফোন করেছি, বলেছি নির্বাচনে আসুন, সর্বদলীয় সরকার গঠন করি। এই সরকারে যে যে মন্ত্রণালয় চান সব আপনাকে দেব। কিন্তু উনি (খালেদা জিয়া) নির্বাচনে না এসে তিনটি বছর ধরে পুড়িয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ ও নাশকতা চালালেন। কিন্তু দেশের জনগণ তাদের সেই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়েছে। আমরা ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলবোই।