দেশের মেয়েদেরও বঙ্গমাতার আদর্শ নিয়েই চলা উচিত : শেখ হাসিনা

নিউজ ডেস্ক :
বঙ্গমাতা জীবন মরণে বাবার একজন উপযুক্ত সাথী হিসাবেই চলে গেছেন জানিয়ে আমাদের দেশের মেয়েদেরও বঙ্গমাতার আদর্শ নিয়েই চলা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেছেন, ‘আমি মনে করি দেশের মেয়েদেরও বঙ্গমাতার আদর্শ নিয়েই চলা উচিত। একটা ত্যাগের মধ্য দিয়ে একটা সংসারকে সুন্দর করা যায়, একটা প্রতিষ্ঠানকে সুন্দর করা যায়, একটা দেশকে সুন্দর করা যায়, চাওয়া পাওয়ার উর্ধ্বে উঠে নিজেকে বিলিয়ে দেয়া; এর থেকে বড় আর কিছু হয় না। আমার মা সেই দৃষ্টান্তই রেখে গেছেন।
শনিবার (৮ আগস্ট) সকালে গণভবন থেকে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ভিডিও কনফারেন্সিয়ের মাধ্যমে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেসা মুজিবের জন্মবার্ষিকী উদযাপনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে একথা বলেন।
‘বঙ্গমাতা ত্যাগ ও সুন্দরের সাহসী প্রতীক’ শীর্ষক প্রতিপাদ্য নিয়ে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে সংযুক্ত হন শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা।
শাহবাগের বাংলাদেশ শিশু একাডেমি ও গোপালগঞ্জে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে ভিডিও কনফারেন্সে সংযুক্ত হয়ে বঙ্গমাতার জন্মবার্ষিকীর কর্মসূচি পালন করা হয়। বঙ্গমাতার জন্মদিনে সারাদেশে ৩২০০ দুস্থ নারীদের মাঝে সেলাই মেশিন, মোবাইল ব্যাংকিয়ের মাধ্যমে ১৩০০ নারীদের নগদ অর্থ প্রদান এবং গোপালগঞ্জ জেলার মেধাবী শিক্ষার্থীদের মাঝে ল্যাপটপ বিতরণ কর্মসূচি পালন করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার বাবা যখন প্রধানমন্ত্রী হয়ে ফিরে এলেন। তখনো কিন্ত তিনি যে প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী, আমার মায়ের মধ্যে এই অহমিকা বোধ কখনো ছিল না। তিনি কখনো সরকারি বাসভবনে এসে বসবাস করেননি। কাজের জন্য বাবা বাড়িতে সকালে নাস্তা করে চলে আসতেন। আবার দুপুরের খাবারটা আমার মা নিজের হাতে রান্না করে টিফিন ক্যারিয়ার করে পাঠিয়ে দিতেন। আব্বার খাবারটা তিনি সবসময় নিজের হাতে করতেন। তিনি যে প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী, পাকের ঘরে কেন রান্না করবেন, সেই সমস্ত চিন্তা তার ছিল না। তিনি জানতেন, তার নিজের হাতে করতে হবে।
নিজের মায়ের হাতে রান্না সুস্বাদু ছিল তার প্রশংসা করে বঙ্গমাতার বড় মেয়ে শেখ হাসিনা আরও বলেন, নিজে কখনো গণভবনে বা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে এসে তিনি থাকেননি। না থাকার কারণটা হচ্ছে, যে কথাটা সবসময় বলতেন, ছেলে মেয়েকে নিয়ে আমি এরকম সরকারি বাসভবনে শানশওকতে থাকবো না। কারণ তারা বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত হোক, সেটা আমি চাই না। এই যে বিলাসীতায় আমরা যেন গা না ভাসাই তার বিষয়ে তিনি যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। এব্যাপারে আমাদের প্রত্যেককে সবসময় সেই শিক্ষাই দিয়েছেন। কারণ শিক্ষা পেয়েছি বাবা-মায়ের কাছে মাটির দিকে তাকিয়ে চলার অর্থ্যাৎ তোমার থেকে খারাপ অবস্থায় কে আছে তাকে দেখো; উপর দিকে তাকিয়ে না, ভাল কে আছে সেটা না। তোমার থেকে কে খারাপ আছে তার থেকে তুমি কত ভাল আছো সেটাই উপলব্ধি করো।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কখনো নিজের দৈন্যতার কথা বলতেন না। কখনো কোন চাহিদা ছিল না। নিজে কোনদিন কিছু চাননি। সবসময় তিনি দিয়ে গেছেন। যেহেতু আমার মায়ের বাবা-মা মৃত্যুবরণ করেন অনেক ছোট বয়সে, তাই তার দাদা এই অল্প বয়সেই বিয়ে দেন এবং সমস্ত সম্পত্তি কিন্তু আমার মা এবং খালার নামে লিখে দেন। সেই সম্পত্তি থেকে তিনি যে অর্থ উপাজর্ন করতেন। সেটা তিনি জমিয়ে রাখতেন এবং আমার বাবা যেহেতু ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতি করত, সেটা তার হাতেই তুলে দিতেন।এভাবেই সময় মানুষকে দেবার একটা মানসিকতা তার মাঝে ছিল।
সচেয়ে বড় কথা, রাজনৈতিক অঙ্গণে বিভিন্ন সময় যখন একটা কঠিন সিদ্ধান্তের বিষয়। সেখানে আমি দেখেছি, আমাকে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আমাদের অনেক বড় বড় অভিজ্ঞ নেতারাও যেখানে সঠিক সিদ্ধান্তটা নিতে পারেননি হয়ত বা একটা ভুল সিদ্ধান্ত দিতে গেছেন। সেখানে আমার মা ঠিক সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তটাই নিয়েছেন, বলেন শেখ হাসিনা।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আমার মাকেও জড়ানোর ষড়যন্ত্র হয়েছিল উল্লেখ করে পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে নেপথ্যে বঙ্গমাতার আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলার দক্ষতার প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। ছয় দফা আন্দোলন এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র দেবার পরেই যে চক্রান্তগুলি চলছিল তার বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করার পিছনে তখনকার ছাত্র ও শ্রমিকদের যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার পিছনে তার অনবদ্য ভ’মিকার কথা তুলে ধরেন।
শেখ হাসিনা বলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন আমার বাবাকে গ্রেফতার করতে এসেছিল তখনও কিন্তু তাদের গ্রেফতার করার একটা উদ্দেশ্য ছিল, তাকে হত্যা করা। মা সামনে দাঁড়িয়ে থাকায় হত্যা করতে পারেনি। আর আমাদের দুভার্গ্য যে, বাংলাদেশ আমার বাবা নিজে সৃষ্টি করলেন। যে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী তার নিজের হাতে সৃষ্টি। পাকিস্তান আমলের সেনাবাহিনীর সদস্যরা মেজরের উপরে কোন প্রমোশন পেত না। আর স্বাধীন দেশে মেজরদের নিজের হাতে প্রমোশন দিয়ে তিনি মেজর জেনারেল করেছিলেন।
মেজর জেনারেল জিয়া থেকে শুরু করে মেজর হুদা, নূর, হারুন, কর্ণেল ফারুক, কর্ণেল রশিদ, কর্ণেল ফারুক তো আমাদের বাড়িতে ডিউটিতেই ছিল সিকিউরিটির জন্য। তারাই খুন করল, তারাই হত্যা করল। আর মেজর ডালিম, ডালিমের শ্বাশুড়ি-বউ তো সার্বক্ষণ আমাদের বাসায়। এমনকি ৩০ জুলাই বাংলাদেশ ছেড়ে জার্মানিতে যাই আমি আর রেহানা। ২৭ তারিখে জয়ের জন্মদিন। আর কখনো জন্মদিন খুব ফূর্তি করে করতাম না। খুব ঘরোয়াভাবে কিন্তু সেদিনেও ডালিমের শ্বাশুড়িরা সবাই এসে হাজির। তাদের দাওয়াত-টাওয়াত লাগত না। যখন তখনেই আসত। সেদিনও এসেছে। সেটা তো আমরা নিজেরাই দেখে গেলাম। তারপরও কত বেঈমানি মুনাফেকী তারা করেছে। আপনারা একবার চিন্তা করে দেখেন?
১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহতদের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, এই রকম একটা জঘন্য ঘটনা। আমার মা, তিনি তো জীবন ভিক্ষা চাননি। তিনি তো নিজে বাঁচতে চাননি। তিনি সাহসের সঙ্গেই সেখানে একথাই বলেছেন, আমার স্বামীকে হত্যা করেছো, আমি তার কাছেই যাব। সেখানেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। কাজেই জীবন মরণে তিনি আমার বাবার একজন উপযুক্ত সাথী হিসাবেই তিনি চলে গেছেন।
আজকে তার জন্মদিন। যিনি তার জন্মেও তিন বছর পর থেকেই পিতা মাতা সব হারিয়ে সারাটা জীবন শুধু সংগ্রামই করে গেছেন। কষ্টই করে গেছেন। এই দেশের স্বাধীনতা; এই স্বাধীনতার জন্য তিনি যে কত দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন, সেটা আমরা নিজেরাই জানি। এই দেশ স্বাধীন হবে। বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি আসবে। বাংলাদেশের মানুষ ভাল থাকবে। আব্বার যে আদর্শটা সেই আদর্শটা তিনি খুব সঠিকভাবে নিজে ধারণ করেছিলেন। আর সেটাকে ধারণ করেই তিনি নিজের জীবনটাকে উৎসর্গ করে দিয়ে গেছেন বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।