ফুটপাতে শতাধিক লাইনম্যানের বেপরোয়া চাঁদাবাজি

0
footpath20170128114730

footpath20170128114730

দিনবদল নিউজ: ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) ফুটপাতে শতাধিক লাইনম্যান কোটি টাকার চাঁদাবাজি করছেন। তারা ডিএসসিসিকে ত্রিশটি সেক্টরে ভাগ করে চাঁদা আদায় করছেন বলে হকার্স লীগ সূত্রে জানা গেছে।

এই লাইনম্যানদের সহযোগী হিসেবে রয়েছেন আরো অন্তত ৬০ জন। চাঁদার অর্থের পুরোটাই চলে যাচ্ছে চাঁদাবাজ ও তাদের নিয়ন্ত্রকদের পকেটে। প্রশাসনের ছত্রছায়ায় এই চাঁদাবাজি চলছে বলে ওই সূত্রে জানা গেছে।

ফুটপাত দখল মুক্ত করতে বিভিন্ন সময়ে হকারদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার সময় এই চাঁদাবাজদের প্রতিরোধের মুখ পড়তে হয় সিটি কর্পোরেশনকে। অপেক্ষাকৃত দরিদ্র ও দুর্বল হওয়ায় এই চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলতে পারেন না হকাররা। নিরবেই ব্যবসার কিছু অংশ দিন শেষে চাঁদাবাজদের দিয়ে দিতে হয়।

সম্প্রতি নগর ভবনে হকার নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠক করেন দক্ষিণ সিটির মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। বৈঠকে হকার নেতারা লাইনম্যান নামধারী চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জোর দাবি জানান। এসময় মেয়র চাঁদাবাজদের তালিকা ও নাম জানতে চান।
বৃহস্পতিবার এ সংক্রান্ত একটি তালিকা নগরভবনে মেয়রের দফতরে পৌঁছে দেন বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশন ও হকার্স লীগের সভাপতি এম এ কাশেম।

রাজধানীর ফুটপাতে হকার সমস্যা দীর্ঘদিনের। বিভিন্ন সময় হকারদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান করেও ফুটপাত দখলমুক্ত করা যাচ্ছে না। অভিযান শেষে ফের বসে পড়ে হকাররা। এ অবস্থায় হকারদের পুনর্বাসনের জন্য তালিকা তৈরি করে দক্ষিণ সিটি। তালিকা অনুযায়ী গুলিস্তান ও তার আশপাশের এলাকায় দুই হাজার ৫০৬ জন হকার রয়েছেন। এছাড়া পুরো দক্ষিণ সিটিতে আরো অন্তত আড়াই লাখ হকার রয়েছেন। এসব হাকারদের কাছ থেকে নিয়মিত ২০০ টাকা হারে চাঁদা আদায় করেন লাইনম্যানরা।

হকার্স লীগের দেওয়া তথ্য মতে, লাইনম্যান নামধারী চাঁদাবাজরা দক্ষিণ সিটিকে ত্রিশটি সেক্টরে ভাগ করে চাঁদাবাজি করছেন। এই ৩০টি এলাকায় ৩০ জন লাইনম্যান ও তাদের দুইজন করে সহযোগী রয়েছেন। এছাড়া এসব এলাকার মাদক, মলম ও অজ্ঞান পার্টি এবং ছিনতাইকারীচক্রসহ সব ধরনের অপরাধীদের সবকিছু ‘ম্যানেজ’ এর দায়িত্ব পালন করেন এই লাইনম্যানরা।

হকার্স লীগের তথ্য অনুযায়ী, এই ৩০ জনের সিন্ডিকেটের সর্দার হচ্ছেন বাবুল। তার নেতৃত্বে হকারদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করা হয়। টাকা আদায়ের পর মাঠ পর্যায়ে নেতৃত্ব দেন আমিন। এরপর এসব টাকা বাবুলের হাত হয়ে যায় দুলালের কাছে।

সূত্র জানায়, প্রতিদিন হকার প্রতি ২০০ টাকা ওঠানো হয়। এই হিসেবে ২ হাজার ৫০৬ জন হকারের কাছ থেকে দৈনিক উঠে ৫ লাখ টাকা। মাসে উঠছে দেড় কোটি টাকা। এই টাকা তিন ভাগে ভাগ হয়। একটি ভাগ যাচ্ছে প্রশাসনের অসাধু সদস্যদের নামে, দ্বিতীয়টি অসাধু রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও স্থানীয় সন্ত্রাসীদের নামে এবং তৃতীয় ভাগটি পাচ্ছে লাইনম্যান, সর্দারসহ সংশ্লিষ্ট চাঁদাবাজরা।

তালিকা অনুযায়ী, গুলিস্তান আহাদ পুলিশ বক্সের উত্তর পাশের ফুটপাতে হকারদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে মো. হারুন ওরফে লম্বা হারুন (৪৭) ও নাজিমুদ্দিন হাওলাদার। তাদের বাড়ি মুন্সিগঞ্জের ডহিরন তাপসি।

মওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়ামের পশ্চিম পাশের ফুটপাতে চাঁদা তোলেন মিরহাজীরবাগের মৃত মফিজ উদ্দিন দেওয়ানের ছেলে মো. আলী মিয়া ও লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জ উপজেলার মৃত আব্দুল হালিমের ছেলে আব্দুল গফফুর।

মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের পাশের ফুটপাতে চাঁদা আদায় করেন জামাল পুরের সরিষাবাড়ীর মৃত আব্দুল মান্নানের ছেলে মো. সাইফুল ইসলাম ও সাইফুল ইসলামের ছেলে মো. শিবলু।

বাইতুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটে নারায়নগঞ্জের সোনারগাঁও থানার মৃত মফিজ উদ্দিনের ছেলে আব্দুল কাদের। বাইতুল মোকাররমের পশ্চিম কার পার্কিংয়ের সামনে শুক্কুর মিয়ার ছেলে মো. কোটন মিয়া। বাইতুল মোকাররমের পশ্চিমে স্বর্ণ মার্কেটের সামনের ফুটপাতে চট্টগ্রামের পটিকছড়ি উপজেলার আমানিয়ার ছেলে মো. হারুন। বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেট হতে ক্রিড়া পরিষদ ভবন পর্যন্ত চাঁদা তোলেন সাজ (৪৪), রহিম (৫৫) ও নুরু (৫২)।

বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে ডনপ্লাজার পূর্বপাশের ফুটপাতে চট্টগ্রামের কালুর ঘাট এলাকার সিতানাথ দাশের ছেলে হরিপদ দাশ। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে সোনালি ব্যাংকের দক্ষিণ লিংক রোডে চাঁদা তোলেন মিজান (৩৭), শওকত (৪০), শাহ-আলম, লিয়াকত হোসেন রনি (৪২) ও জাকারিয়া হানিফ।

বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে সোনালী ব্যাংকের সামনের ফুটপাতে থেকে চাঁদা তোলেন আব্দুস সালাম। ১৬ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউস্থ বিল্ডিংয়ের সামনের ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলেন তিনজন। এরা হলেন- আক্তার হোসেন, জাহাঙ্গীর আলম ও কালা নবী।

বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার সামনের ফুটপাতে আবুল হাশেম কবির। পুরানা পল্টনস্থ আজাদ প্রোডাক্স বিল্ডিং এলাকায় চাঁদা তোলেন মো. দুলাল।

গুলিস্তান সিনেমাহল মার্কেটের পূর্বপাশের ফুটপাতে মো. বাবুল। তিনি এই এলাকা ছাড়াও আশপাশের চাঁদাবাজদের সরদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। গুলিস্তান আহাদ বক্সের দক্ষিণ পাশের ফুটপাতের টাকা তোলেন মো. আমিন।

ওসমানী উদ্যানের পূর্বপাশের ফুটপাতে মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর থানার বাড়েইগাও গ্রামের মো. শাজাহান ওরফে নাম্বু শাজাহান। গুলিস্তানের সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটের উত্তর পারে ফুটপাত ও রাস্তায় মৃত লাল মিয়ার ছেলে জজ মিয়া ওরফে মোটা জজ। গুলিস্তান ট্রেড সেন্টারের দক্ষিণ ও পূর্ব পাশের ফুটপাত ও রাস্তায় চাঁদা তোলেন তিনজন। এরা হলেন- মো. সেলিম, ভোলা ও সালেহ।

মতিঝিল রূপালি ব্যাংকের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে তাজুল ইসলামের ছেলে মো. বাবলু। দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ও পুলিশ হেড কোয়াটার্সের সামনের রাস্তার উত্তর পাশ থেকে থেকে চাঁদা তোলেন শ্রী শাহীন। জাতীয় গ্রন্থভবন থেকে রেলওয়ে হকার্স মার্কেটের পশ্চিম পাশে ফুটপাত ও রাস্তার হকারদের কাছ থেকে চাঁদা তোলেন সুলতান (৫৫) ও লিফু (৪৫)।

রমনা ভবন মার্কেটের পশ্চিম পাশের ফুটপাত ও রাস্তায় চাঁদা তোলেন মনির (৪৫) ও শফিক (৪৫)। গুলিস্তান হল মার্কেটের উত্তর পাশে ফুটপাত ও রাস্তায় চাঁদা তোলেন হাসান (৪৫), খোরশেদ ওরফে বড় মিয়া (৫০) এবং কালাম (৪৮)। এছাড়া শ্রী বিমল (৫৫), সওকত (৪৭) ও হাবীবও (৪৮) চাঁদা আদায় করেন।

মতিঝিলের আমেরিকান লাইফ ইন্স্যুরেন্স থেকে শুরু করে সোনালি ব্যাংক হয়ে মতিঝিল অগ্রণী ব্যাংক পর্যন্ত চাঁদা তোলেন সাদেক (৪৫), আব্দুর রহিম (৫৫), শ্রী পবন (৪৭) ও নুরুল ইসলাম (৫০)।

নিউমার্কেট, গাউছিয়া, বলাকা সিনেমা হল, বাকুশা মার্কেট ও ঢাকা কলেজের সামনে চাঁদা তোলেন ৯ জন। এরা হলেন- আব্দুস সাত্তার মোল্লা (৫৭), রফিক (৪৮), ইব্রাহীম ওরফে ইবু (৪৬), শাহাদাত (৪২), মিজান (৩৮), শহীদ (৪০), মাইনুল ও আমিনুল।

গোলাপশাহ মসজিদের দক্ষিণ পাশ হতে ফুলবাড়িয়া পর্যন্ত এলাকায় চাঁদা তোলেন মো, বাবুল (৪৫), ইমরান (৫০), দোলন (৩৮) ও মো. মানিক (৫২)।

এসব চাঁদাবাজদের বিষয়ে ডিএসসিসি মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, লাইনম্যান নামধারী কিছু লোক ফুটপাতে চাঁদাবাজি করছে। এদের নাম আমাদের কাছে রয়েছে। এরই মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। চাঁদাবাজরা যেই হোক তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *