ফেসবুকে লাইক-শেয়ার দিয়ে ফাঁসবেন না

যাচাই-বাছাই ছাড়া ফেসবুকে লাইক-শেয়ার দেওয়ায় সাবধান! বিশেষ করে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের এ ব্যাপারে বেশি সতর্ক থাকতে হবে। উগ্রপন্থি কোনো লেখা শেয়ার করা বা তাতে মন্তব্য করলেই বিপদে পড়তে পারেন। জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত থাকার অভিযোগে সিঙ্গাপুর থেকে সম্প্রতি প্রবাসী শ্রমিকদের ফেরত পাঠানোর পর ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলা তদন্ত করতে গিয়ে এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে পুলিশের।
একাধিক দফায় ৩৯ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠায় সিঙ্গাপুর সরকার। দেশে তাদের আইনের হেফাজতে নেয় পুলিশ। মামলা করা হয় সন্ত্রাস দমন আইনে। ৮টি মামলার তদন্ত করছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। তদন্তে ৩-৪ জন ছাড়া সিঙ্গাপুর থেকে পাঠানো বাকি শ্রমিকদের উগ্রপন্থি তৎপরতায় জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অজ্ঞতার কারণে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উগ্রপন্থি কিছু সাইটে ‘লাইক’, ‘কমেন্ট’ ও ‘শেয়ার’ করতে গিয়ে তারা ফেঁসে গেছেন। এই অভিজ্ঞতা থেকে ভবিষ্যতে বিদেশগামী শ্রমিকদের ইন্টারনেট, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের জন্য পরিকল্পিত প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি বলে মনে করছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। এর ব্যত্যয় হলে জঙ্গিবাদ ইস্যুতে প্রবাসীদের নিয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। জঙ্গি অপবাদ দিয়ে প্রবাসীদের দেশে ফেরত পাঠানো হলে তাদের পরিবার আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্ট মামলাগুলোর তদন্ত ও তদন্তে পাওয়া তথ্য সিঙ্গাপুরের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানাবে বাংলাদেশ পুলিশ। প্রয়োজনে তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা সিঙ্গাপুরে যাবেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সিটিটিসির ডিসি মুহিবুল ইসলাম খান বলেন, জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে সম্প্রতি সিঙ্গাপুর থেকে যাদের ফেরত পাঠানো হয়েছে তারা জঙ্গিবাদে জড়িত এমন সন্দেহাতীত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অধিকাংশ না বুঝে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উগ্রপন্থি কিছু লেখা শেয়ার করে বা লাইক দিতে গিয়ে ফেঁসে গেছেন। কারণ, সিঙ্গাপুরের সাইবার ক্রাইম আইনটি অত্যন্ত কঠোর। এ ব্যাপারে আমাদের শ্রমিকদের আরও সতর্ক হতে হবে। এসব ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ধারণা দিয়ে তাদের বিদেশ পাঠাতে হবে।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জাবেদ আহমেদ জানান, গত বছরের নভেম্বর থেকে বিদেশগামী শ্রমিকদের জন্য তারা বিদেশে গিয়ে কীভাবে ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করবে তার একটি দিকনির্দেশনা দেওয়ার কর্মসূচি চালাচ্ছেন। সিঙ্গাপুর থেকে কয়েকজন বাংলাদেশি শ্রমিককে ফেরত পাঠানোর পর ওই কর্মসূচি নেওয়া হয়।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিত্রুক্রটিং এজেন্সিসের (বায়রা) সভাপতি বেনজীর আহমেদ বলেন, যারা প্রবাসী শ্রমিক তাদের অধিকাংশ ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের সঠিক নিয়ম জানে না। কী করলে জঙ্গি হিসেবে তারা সন্দেহভাজন হয়ে পড়তে পারে- এ ব্যাপারে তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নেই। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বিদেশগামী শ্রমিকদের এ ব্যাপারে আরও সচেতন করতে হবে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিঙ্গাপুরফেরত ৩৯ জনকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, তাদের অধিকাংশ বিভিন্ন সময় উগ্রপন্থি কিছু লেখা লাইক ও শেয়ার দিয়েছেন। পুলিশ জানায়, ৩-৪ জন আনসারুল্লাহ নেতা জসীমুদ্দীন রাহমানির লেখা শেয়ার করেছেন। হয়ত তারা বাংলাদেশে এসে কখনও উগ্রপন্থায় জড়াতে পারেন এমন পরিকল্পনা থাকতে পারে। নিজেদের মতাদর্শ ছড়িয়ে দিতে কেউ কেউ সেখানে চাঁদাও তুলেছেন। এই সন্দেহভাজনদের নিয়ে আরও গভীরভাবে অনুসন্ধান চলছে। তবে সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত আসা অধিকাংশ শ্রমিক সম্পূর্ণ অজ্ঞতার কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সন্দেহভাজন উগ্রপন্থি লেখা শেয়ার ও লাইক দিয়ে ফেঁসেছেন।
তদন্ত সূত্র জানায়, ৩৯ জনকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো ছাড়া কয়েকজনকে সিঙ্গাপুরে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশিদের গ্রেফতার করার পর সিঙ্গাপুর পুলিশ দাবি করে আসছিল, বাংলাদেশে সরকার উৎখাত ও খিলাফত প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেছিল আটক ব্যক্তিরা। তাদের মধ্যে অন্তত ৮ জন ‘ইসলামিক স্টেট ইন বাংলাদেশ (আইএসবি)’ নামে একটি গোষ্ঠী গড়ে তুলতে চেয়েছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে ‘সশস্ত্র জিহাদ’ করা।
বিদেশে থেকে ফেরত পাঠানো একাধিক শ্রমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানান, তারা মূলত সাধারণ শ্রমিক। তারা সেখানে গিয়ে ফাঁদে পড়েন। বয়ানের কথা বলে তাদের একত্র করা হতো।
পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, শুধু বিদেশে নয়, দেশেও অনেকে জঙ্গি-সংক্রান্ত অনেক লেখায় না বুঝে লাইক ও শেয়ার দিয়ে খণ্ডকালীন ঝামেলায় পড়েছেন। কারণ, অনলাইন মনিটরিংয়ের জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক টিম রয়েছে। কারা, কীভাবে কোথায় উগ্রপন্থি কোনো লেখা শেয়ার, লাইক দিচ্ছেন তার ওপর নজর রাখেন।