বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি,অবশেষে মামলা হচ্ছে!

0
b abank

b abank

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ৫৩১ কোটি টাকা (৬ কোটি ৬৪ লাখ ডলার) ফেরত আনতে অবশেষে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। প্রচলিত আইনের বিধান অনুযায়ী ঘটনা সংঘটিত হওয়ার ৩৬ মাসের মধ্যে ফিলিপাইনের আরসিবিসি ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে বাংলাদেশকে। এরই মধ্যে অতিবাহিত হয়েছে ২১ মাস। এ সময়ে উদ্ধার করা হয়েছে প্রায় ১১৭ কোটি টাকা (১ কোটি ৪৬ লাখ ১০ হাজার ডলার)। এ ব্যাপারে আর তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় টাকা ফেরত আনার উদ্যোগের পাশাপাশি নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই মামলা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার আজমালুল হক কিউসির লিখিত মতামত চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি মামলা করার ব্যাপারে একমত পোষণ করেছে রিজার্ভ চুরির অর্থ ফেরত আনা সংক্রান্ত সরকার গঠিত টাস্কফোর্সও। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব এবং রিজার্ভ চুরির অর্থ ফেরত আনা সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের প্রধান মো. ইউনুসুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আরসিবিসি ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য আইনজ্ঞের মতামত নিয়ে রাখা হয়েছে। টাকা উদ্ধারের ব্যাপারে মামলা করার একটি নির্ধারিত সময় আছে। সে সময়ের মধ্যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় টাকা উদ্ধারের অগ্রগতি না হলে আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে। তিনি বলেন, মামলা হচ্ছে একটি দীর্ঘসূত্রতা। কিন্তু এরপরও মতামত সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) উপদেষ্টা দেব প্রসাদ দেবনাথ যুগান্তরকে বলেন, রিজার্ভ চুরির অর্থ উদ্ধারের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মামলা করার বিষয়ে জানতে চেয়েছে সরকার গঠিত টাস্কফোর্স। এ ধরনের মামলা দায়ের করার ক্ষেত্রে একটি কলাকৌশল অনুসরণ করতে হয়। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মামলাটি করা হলে, সেটি ফিলিপাইনে করা হবে, নাকি যুক্তরাষ্ট্রে হবে- তা নিয়ে চলছে নানা হিসাব-নিকাশ। তবে বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ফিলিপাইনে মামলা করা হলে, রায় পেতে কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ বছর লেগে যেতে পারে। আর যুক্তরাষ্ট্রে এ মামলা দায়ের করা হলে তা নিষ্পত্তিতে এর চেয়ে কম সময় লাগবে।

উল্লেখ্য, রিজার্ভ চুরির অপরাধে ইতিমধ্যেই দুটি পৃথক মামলা হয়েছে। এর একটি করেছে যুক্তরাষ্ট্র এবং অপরটি করেছে ফিলিপাইন।

প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে সংরক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ১০ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার চুরি হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের আইডি ও পাসওয়ার্ড দিয়ে সুইফটের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে ৩৫টি অবৈধ ভুয়া পেমেন্ট ইন্সট্রাকশন দেয় হ্যাকাররা। এরপর ৫টি পেমেন্ট ইন্সট্রাকশনের এ অর্থ হাতিয়ে নেয়া হয়। এর মধ্যে ২ কোটি ডলার চলে যায় শ্রীলংকায়। বাকি ৮ কোটি ১০ লাখ ১০ হাজার মার্কিন ডলারের মধ্যে ফিলিপাইনের ক্যাসিনো ব্যবসায়ী কিমওয়া ১ কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার হাতিয়ে নেন।

পরে ফিলিপাইন সরকার এ অর্থ উদ্ধার করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠায়। এছাড়া আরসিবিসি ব্যাংকে জমা থাকা ৭০ হাজার ডলারও ফেরত এসেছে। অর্থাৎ মোট ফেরত পাওয়া অর্থের পরিমাণ হচ্ছে ১ কোটি ৪৬ লাখ ১০ হাজার ডলার (১ কোটি ১৬ লাখ ৮৮ হাজার টাকা)। বাকি ৬ কোটি ৬৪ লাখ ডলার (৫৩১ কোটি ২০ লাখ টাকা) ফিরিয়ে আনতে মামলা করা হচ্ছে বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্র।

আরও জানা গেছে, ৬ কোটি ৬৪ লাখ ডলারের মধ্যে ২ কোটি ৮০ লাখ ডলার আছে সোনেয়ার রিসোর্ট ও ক্যাসিনো ম্যানিলার ব্যাংক হিসাবে, ১ কোটি ৭০ লাখ ডলার আছে ফিলিপাইনের রেমিটেন্স কোম্পানি ফিলরেমোর হিসাবে। আর ৬০ লাখ ডলার এখনও রয়েছে কিম অং-এর কাছে। এছাড়া ১২ লাখ মার্কিন ডলারের সন্ধান পাওয়া গেছে কিম ওয়াংয়ের দু’জন কর্মচারীর ব্যাংক হিসাবে। তবে এখনও পর্যন্ত কোনো সন্ধান মেলেনি ১ কোটি ৪২ লাখ ডলারের।

আরসিবিসি ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি : সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রিজার্ভ চুরির অর্থ ফেরত আনতে ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের (আরসিবিসি) ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নিযুক্ত আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার আজমালুল হক কিউসির কাছ থেকে লিখিত মতামত নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সম্প্রতি সরকারের উচ্চপর্যায়ে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটকে (বিএফআইইউ)।

মামলা করার আগে ফিলিপাইনসহ আন্তর্জাতিক কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে গত ৬ থেকে ৯ জুন পর্যন্ত ফিলিপাইন সরকারের বিভিন্ন সংস্থা বিশেষ করে বিচার বিভাগ, ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও এফআইইউ, প্রেসিডেন্সিয়াল কমিশন অন গুড গভর্নমেন্ট, ফিলিপাইনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সলিসিটর জেনারেল প্রধান ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএফআইইউ ও সিআইডির প্রতিনিধি এবং আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার আজমালুল হক কিউসি। রিজার্ভের অর্থ উদ্ধারে বাংলাদেশকে সব ধরনের সহায়তা দেয়ার আশ্বাস দিয়েছে এসব সংস্থা।

চীনের সহায়তা চাওয়া হচ্ছে : বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে সম্প্রতি চীনের দুই নাগরিক গ্রেফতার হন। তারা হলেন জীজে ডিং (৪৫) ও শুইহুয়া গাও (৫৩)।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বার্তা সংস্থা ব্লমবার্গ জানিয়েছে, গত বছর মার্চে চীনের পুলিশের হাতে ধরা পড়েন ক্যাসিনো ব্যবসায়ী জীজে ডিং এবং আগস্টে গ্রেফতার হন শুইহুয়া গাও। জীজে ডিং ২০০৭ সালে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ জুয়া কেন্দ্র ম্যাকাওতে বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান চালু করেন। জুয়াড়িদের এনে ক্যাসিনোতে জুয়ার আসর বসাতেন। অন্যদিকে শুইহুয়া গাও পেইচিংয়ে একটি ক্যাসিনো চালান। ফিলিপাইনে অন্তত ২৯টি স্থানে তার ক্যাসিনো নেটওয়ার্ক রয়েছে। তারা দু’জন বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা সরিয়ে নিতে উত্তর কোরিয়ার হ্যাকারদের সহায়তা নিতে পারেন বলে হংকং পুলিশের ধারণা। ওই অর্থ তারা উত্তর কোরিয়াতেও পাঠিয়ে দিতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

জানা গেছে, গ্রেফতারকৃতদের ব্যাপারে চীনের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে বাংলাদেশের সিআইডি। এছাড়া সম্প্রতি অনুষ্ঠিত রিজার্ভ চুরির অর্থ ফেরত আনা সংক্রান্ত সরকারের টাস্কফোর্স বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে গ্রেফতারকৃত দু’জন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য চীনে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূতের সহায়তা নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এজন্য টাস্কফোর্সের সভাপতি এ ব্যাপারে রাষ্ট্রদূতকে চিঠি দেবেন বলেও সিদ্ধান্ত হয়। এ কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্ব দেয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংক, সিআইডি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে।

আদালতে জব্দ ২২৪ কোটি টাকা আনতে আইনি প্রক্রিয়া শুরু : সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের ৬ কোটি ৬৪ লাখ মার্কিন ডলার রিজার্ভ চুরির ২ কোটি ৮০ লাখ ডলার (২২৪ কোটি টাকা) গেছে সোলারি ক্যাসিনিওতে। প্রাথমিকভাবে এ অর্থ ফিলিপাইনের উচ্চ আদালতের নির্দেশে জব্দ করা হয়। পরবর্তীকালে আদালত প্রত্যাহার করে নেয় ওই নির্দেশ। এরপর এ টাকার ওপর পুনরায় ফিলিপাইনের সুপ্রিমকোট কর্তৃক ফ্রিজের আদেশের পক্ষে ‘অস্থায়ী রোধ আইন (টিআরও)’ জারি করা হয়।

সর্বশেষ অনুষ্ঠিত রিজার্ভ ফেরত আনা সংক্রান্ত টাস্কফোর্স বৈঠকে বলা হয়, সোলারি ক্যাসিনিওর জব্দকৃত টাকা ফেরত আনতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। এজন্য ফিলিপাইনের আইনি প্রক্রিয়ার সর্বশেষ অগ্রগতির তথ্য সেখানের এন্ট্রি মানি লন্ডারিং কাউন্সিল এবং বিচার বিভাগ (ডিওজে) থেকে সংগ্রহের নির্দেশ দেয়া হয়। এ সংক্রান্ত তথ্য পাওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আর এ কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশ দেয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটকে।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *