সশস্ত্র বাহিনীকে জনগণের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানালেন প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশকে গড়ে তোলা হবে।… জনগণের কল্যাণে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।’ সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার বিকালে সেনাকুঞ্জে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন তিনি। এর আগে সকালে ঢাকা সেনানিবাসে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা/ উত্তরাধিকারীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি- ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য বিশেষ করে সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, আনসার-ভিডিপি এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (তৎকালীন ইপিআর) সদস্য, যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন তাদের ভাতা দেয়া হবে। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, তারা তখন বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন বলে সে সময় তাদের ভাতা দেয়া হয়নি। তারা সবাই প্রায় এখন অবসরে এবং তাদের পরিবারের সদস্যরাও সমস্যায় রয়েছেন… আমরা এদের সবাইকেই আগামী জানুয়ারি থেকে ভাতা দেব ইনশাআল্লাহ।’
সকাল ৮টায় শিখা অনির্বাণে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে সশস্ত্র বাহিনীর শহীদ সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। পরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী উভয়ই কিছুক্ষণ সেখানে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর চৌকস দলের অভিবাদন গ্রহণ করেন। শিখা অনির্বাণ প্রাঙ্গণে রাখা পরিদর্শন বইয়ে স্বাক্ষর করেন। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে প্রধানমন্ত্রী সশস্ত্র বাহিনী বিভাগে যান। সেখানে তিন বাহিনীর প্রধানরা তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।
এর আগে দিবসের কর্মসূচি শুরু হয় দেশের সব সেনানিবাস, নৌঘাঁটি ও বিমানঘাঁটির মসজিদগুলোতে বিশেষ মোনাজাতের মাধ্যমে। বাদ ফজর এ মোনাজাতে দেশের কল্যাণ, সমৃদ্ধি ও সশস্ত্র বাহিনীর অগ্রগতি কামনা করা হয়।
সেনাকুঞ্জের সংবর্ধনায় শেখ হাসিনা বলেন, এ দেশ আমাদের, এ দেশের যত উন্নতি হবে, মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার ততই উত্তোরণ ঘটবে। শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, খেলাধুলাসহ বিভিন্ন স্তরে আন্তর্জাতিক মান অর্জনের মধ্য দিয়ে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে পরিচিত করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন সবার সহযোগিতা ও ঐকান্তিক ইচ্ছা।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সশস্ত্র বাহিনীকে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম করে তোলার জন্য আমাদের সরকার কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।… আমি তাদের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করি। আপনারা যেন চেইন অব কমান্ড মেনে শৃঙ্খলা ও পেশাগত দক্ষতায় সর্বত্র প্রশংসিত হতে পারেন সেটাই আমার কাম্য।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সশস্ত্র বাহিনী আজ তাদের সততা, নিষ্ঠা, কর্মদক্ষতা এবং নানাবিধ জনসেবামূলক কর্মকাণ্ডের জন্য সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি যে কোনো দুর্যোগকবলিত অঞ্চলে আর্তমানবতার সেবা ও জানমাল রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনী যে আন্তরিকতা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে বিপর্যস্ত জনগণের পাশে দাঁড়ায় তা জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ রাখবে। জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের সহায়তায় সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকাও দেশে-বিদেশে বহুল প্রশংসিত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তার সরকার সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নে বিভিন্ন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন কাজ শুরু করলেও ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে না পারায় সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেমে যায়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে পুনরায় উন্নয়নের নব দিগন্ত উন্মোচিত হয় এবং জাতির স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের প্রতীক সশস্ত্র বাহিনীর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও সেই থেকে অব্যাহত রয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে প্রণীত প্রতিরক্ষা নীতিমালার আলোকেই ফোর্সেস গোল-২০৩০ প্রণয়ন করা হয়। এর আওতায় তিন বাহিনীর পুনর্গঠন ও আধুনিকায়নের কার্যক্রমগুলো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ়করণ এবং সেনাবাহিনীর উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে বেশ কিছু ব্রিগেড ও ইউনিট প্রতিষ্ঠা করে। আমরা সিলেটে এবং রামুতে পূর্ণাঙ্গ পদাতিক ডিভিশন প্রতিষ্ঠা করেছি। এছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের পটুয়াখালীতেও শিগগিরই একটি নতুন পদাতিক ডিভিশন প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছি। বর্তমান সরকারের চলতি মেয়াদে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ, অস্ত্র, সরঞ্জামাদি ও জনবলের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লক্ষ্য ছিল একটি দক্ষ ও চৌকস সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলা। তিনি বলেন, স্বাধীনতা উত্তর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের আর্থিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তিনি গভীর প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি নিয়ে একটি আধুনিক সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু সশস্ত্র বাহিনীর যে সুদৃঢ় ভিত্তি রচনা করে গেছেন, তারই ওপর দাঁড়িয়ে আজ আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর পেশাদারিত্ব এবং কর্মদক্ষতার পরিচিতি দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্বীকৃত ও প্রশংসিত হয়েছে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী পৃথকভাবে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর আধুনিকায়নে তার সরকারের পদক্ষেপগুলোর অংশ বিশেষ তুলে ধরেন।
সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে তার সুদৃঢ় পারিবারিক বন্ধনের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার ভাই শহীদ ক্যাপ্টেন শেখ কামাল মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। দ্বিতীয় ভাই শহীদ লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল ১৯৭৫ সালে রয়েল মিলিটারি একাডেমি স্যান্ডহার্সটস থেকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ শেষে কমিশন লাভ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। ২০১৬ সালে সেনাবাহিনীর ফার্স্ট বেঙ্গলের অফিসার হিসেবে ক্যাপ্টেন শেখ কামাল ও সেকেন্ড বেঙ্গলের অফিসার হিসেবে লেফটেন্যান্ট শেখ জামালকে সম্মাননা প্রদান করায় আমি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ জানাই।
শেখ হাসিনা বলেন, ছোট ভাই রাসেলের ইচ্ছা ছিল বড় হয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেবে। সে সেনাবাহিনীর সুশৃঙ্খল কার্যক্রম দেখে অত্যন্ত উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু ঘাতকের নির্মম বুলেট তার ছোট্ট বুক মাত্র ১০ বছর বয়সেই বিদীর্ণ করে।
প্রধানমন্ত্রী পরে অনুষ্ঠানে উপস্থিত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য এবং তাদের পরিবার, কূটনীতিক এবং আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন।
প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকী, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মুহম্মদ শফিউল হক, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল নিজামউদ্দিন আহমেদ এবং বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল আবু এসরার অনুষ্ঠানে ছিলেন।
সংবর্ধনায় অংশ নেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী, ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিয়া, জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ, প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা, মন্ত্রী পরিষদ সদস্য, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতা, ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা, কূটনীতিক ও পদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা।
খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা/উত্তরাধিকারীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান : সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. মাহফুজুর রহমান স্বাগত বক্তব্য দেন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা, তিন বাহিনীর প্রধান অনুষ্ঠানে ছিলেন।
শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানে সম্মানী চেক এবং মোবাইল ফোন ও ট্যাবসহ বিভিন্ন উপহার ৭ বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার এবং মুক্তিযুদ্ধে সম্মাননা পদকপ্রাপ্তদের মাঝে বিতরণ করেন। ‘শান্তিকালীন’ পদক ২০১৬ বিজয়ী ১২ জন এবং ‘অসামান্য সেবা’ পদক বিজয়ী ১৪ সদস্যের মাঝে পদক বিতরণ করেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, সশস্ত্র বাহিনী দিবসে আমি এখানে এলেই প্রতিবছর এ (ভাতা দেয়ার) দাবি উঠত। কাজেই আমরা এটি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে সরকার সম্ভাব্য সব কিছু করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন এবং আত্মাহুতি দিয়েছেন তাদের আমরা মর্যাদা দেয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের ভূমিকার প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সরকার সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন ও সব ধরনের কল্যাণমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ইউনেস্কো ‘ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ ঘোষণার প্রসঙ্গ তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণ হয়েছে যে, ইতিহাসকে কখনও মুছে ফেলা যায় না এবং ইতিহাস তার স্থান একদিন ঠিকই করে নেবে। এটা এখন প্রমাণিত।
সেনাকুঞ্জে যায়নি বিএনপি : বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবিহ উদ্দিন আহমেদকে সেনাকুঞ্জে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু তারা অনুষ্ঠানে যোগ দেননি। মাহবুবুর রহমান জানান, মহাসচিব ঢাকার বাইরে ছিলেন। তিনি অসুস্থ থাকায় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেননি।
[two_third]