হত্যার পরদিন সিনহার বাসায় যায় পুলিশ, তখনো জানায়নি মৃত্যুর কথা

0

তথ্যচিত্র বানানোর জন্য ঢাকার উত্তরার নিজ বাসা থেকে নিজের গাড়িতে করে গত ৩ জুলাই কক্সবাজারের টেকনাফে যান মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান। প্রায় প্রতিদিনই তিনি মুঠোফোনে মা নাসিমা আক্তার ও বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌসের সঙ্গে কথা বলতেন। মা নাসিমা আক্তার রাতে কথা বলে ঘুমোতে যেতেন। সেদিনও (৩১ জুলাই) রাত ১১টার সময় নাসিমা আক্তার সিনহার মোবাইলে ফোন দেন। পাঁচ থেকে সাতবার ফোন দেন। তখন ফোন বেজেই চলেছে।

নাসিমা আক্তার ছেলে সিনহার স্বভাব ভালো করেই জানেন। ফোন করলে যদি না ধরতে পারতেন, তাহলে ফোন আবার ব্যাক করতেন। নাসিমা ভেবেছিলেন, তাঁর ছেলে সিনহা হয়তো ব্যস্ত রয়েছেন, তাই ফোন ধরতে পারেননি। কাজের ব্যস্ততা শেষে নিশ্চয় সিনহা তাঁকে ফোন করবেন।

নাসিমা আক্তার যখন ছেলের ফোনের জন্য অপেক্ষা করছেন, তখন সিনহার গুলিবিদ্ধ লাশ পড়ে আছে কক্সবাজার হাসপাতালের মর্গে। সেদিন রাত ৯টা ২৫ মিনিটের পর টেকনাফের শামলাপুর তল্লাশিচৌকিতে মেজর (অব.) সিনহাকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ।

ওই দিন রাত ১২টার কিছু আগে একটা অপরিচিত নম্বর থেকে সিনহার মায়ের মোবাইলে ফোন আসে। তিনি তা ধরেন। নিজের পরিচয় না দিয়ে লোকটি নাসিমা আক্তারের কাছে সিনহা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে চান।

সিনহার মা নাসিমা আক্তার বলেন, ‘ঈদের আগের দিন রাত ১১টার দিকে আমার ছেলেকে আমি ফোনে পাচ্ছিলাম না। তবে রাত ১২টার আগে একটা নম্বর থেকে আমার কাছে ফোন আসে। আমাকে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, সিনহা আপনার কী হয়? জবাবে আমি বলি, সিনহা আমার ছেলে। পরে আমার কাছে তিনি আরও জানতে চান, সিনহা কী করে? আমি তাঁকে বলি, সিনহা আগে সেনাবাহিনীতে চাকরি করত। এখন কিছুই করে না। টুকটাক কাজ করে। তখন লোকটি জানতে চান, সিনহার কয় ছেলেমেয়ে? তখন তাঁকে আমি বলি, সিনহাকে তো আমি ফোনে পাচ্ছি না। ও কোথায়? লোকটি তখন বললেন, সিনহা আছে। একটু দূরে আছে। আমি তাঁকে বললাম, সিনহার কাছে মোবাইল ফোনটা দেন। একপর্যায়ে লোকটি আমাকে বললেন, আপনি আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলছেন কেন? তখন তিনি নিজের পরিচয় দেন এবং বলেন, আমি টেকনাফ থানার ওসি। ওসি প্রদীপ তখন জানতে চান, আমার ছেলে সিনহা কেন চাকরি কেন ছেড়ে দিয়েছে? আমি বলেছিলাম, ছেলে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে, সেটা তার ইচ্ছা।’

টেকনাফ থানার ওসি যখন ফোন রেখে দিলেন, তখন ছেলে সিনহাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন নাসিমা আক্তার। তবে সিনহাকে যে হত্যা করে ফেলা হয়েছে, সেই বিষয়টি তাঁর কল্পনাতেও আসেনি। তবে নাসিমা আক্তার তখন ধরে নিয়েছেন, হয়তো কোনো কারণে তাঁর ছেলে আছে থানায়। তাঁর ছেলে সিনহার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য টেকনাফ থানার ওসি তাঁকে ফোন দিয়েছেন।

তখন ফের নাসিমা আক্তার টেকনাফ থানার ওসির নম্বরে ফোন দেন। বহুবার কল দিলেও আর তিনি কল ধরেননি। তখন নিরুপায় হয়ে নাসিমা আক্তার সিনহার একজন বন্ধুকে ফোন দেন, যিনি সিনহার ব্যাচমেট ছিলেন। সেনাবাহিনীতে কর্মরত। সিনহার পরিচয় জানার জন্য টেকনাফ থানার ওসি যে তাঁকে ফোন দিয়েছিলেন, সেই বিষয়টি সেনাবাহিনীর ওই কর্মকর্তাকে জানান। সিনহার মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে, সেই তথ্য তাঁকে জানান।

রাত গেল, কিন্তু ছেলে সিনহার কোনো খবর তিনি জানতে পারলেন না। ঈদের দিন সকালেও ছেলের মোবাইল ফোনে বারবার কল দেন। কিন্তু ফোন বন্ধ পান। আবার ঈদের দিন বলে ছেলের বন্ধুকে ফোন দিতে কিছুটা ইতস্তত বোধ করেন। তবে সকাল ১০টার সময় সিনহার ব্যাচমেট সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা তাঁকে ফোন দেন। কিন্তু সিনহার মৃত্যুর তথ্য তাঁকে জানাননি। তবে তাঁর কাছ থেকে সিনহার বড় বোন শারমিন ও তাঁর স্বামী মো. শামসুজ্জামানের মোবাইল ফোন নম্বর নেন।

ঈদের দিন বেলা ১১টার সময় দেখেন, বাসার সামনে তিনজন পুলিশ সদস্য। তাঁদের মধ্যে একজন উপপরিদর্শক (এসআই), দুজন কনস্টেবল। তাঁদের বাসার ভেতরে নিয়ে আসেন। উত্তরা পশ্চিম থানার এসআই সুমন চন্দ্র দাস নাসিমা আক্তারের কাছে সিনহা সম্পর্কে নানা তথ্য জানতে চান। কিন্তু সিনহাকে যে পুলিশ গুলি করে মেরে ফেলেছে, সেই তথ্য জানাননি। বাসা থেকে সিনহার অনেকগুলো ছবি তুলে নিয়ে যান এসআই সুমন চন্দ্র দাস।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *