নিরাপত্তার স্বার্থে দেশি-বিদেশি এয়ারলাইন্সসহ দেশের সব বিমানবন্দরে এক্সট্রা অ্যালার্ট

নিরাপত্তার স্বার্থে দেশি-বিদেশি এয়ারলাইন্সসহ দেশের সব বিমানবন্দরে এক্সট্রা অ্যালার্ট (অতিরিক্ত সতর্কতা) জারি করেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।
একই সঙ্গে দুই থেকে বাড়িয়ে চার স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। বিমান নিয়ে নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগে এক কো-পাইলটসহ চার জঙ্গি গ্রেফতারের পর বেবিচক এ পদক্ষেপ নিচ্ছে।
এর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিমানের ১৫ পাইলট ও কো-পাইলটকে ভয়ঙ্কর ক্যাপ্টেন হিসেবে উল্লেখ করে তাদের নজরদারির আওতায় নিয়েছে। সব এয়ারলাইন্স ও হেলিকপ্টার কোম্পানিকে তাদের পাইলট, কো-পাইলট, কেবিন ক্রু ও প্রকৌশল বিভাগের সদস্যদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও ছাত্র জীবনের রেকর্ড সংগ্রহ করে রাখতে বলা হয়েছে। ককপিট, কেবিন ক্রু ও প্রকৌশল বিভাগের সদস্যদের (যারা ফ্লাইট পরিচালনা করেন) অতীতে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ রেকর্ড থাকলে তা দ্রুত সিভিল এভিয়েশনকে অবহিত করতে বলা হয়।
বৃহস্পতিবার সকালে সব বিমানবন্দরের শীর্ষ কর্মকর্তা, দেশি-বিদেশি এয়ারলাইন্স ও হেলিকপ্টার কোম্পানির প্রতিনিধিদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করে বেবিচক এসব নির্দেশ দেয়। বৈঠকে সব এয়ারলাইন্সকে বিমানবন্দর ব্যবহার, যাত্রী ও মালামাল পরিবহনে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এছাড়া এখন থেকে দেশি-বিদেশি সব এয়ারলাইন্সের ক্রু ও যাত্রীদের চার স্তরের নিরাপত্তার ভেতর দিয়ে যাতায়াত করতে হবে। এ নিরাপত্তা বেষ্টনির একটি স্তরে পাহারায় থাকবে সদ্য যুক্তরাজ্য থেকে আনা প্রশিক্ষিত ডগ স্কোয়াড। বর্তমানে বিমানবন্দরে দুই স্তরের নিরাপত্তা আছে। নতুনভাবে নেয়া চার স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনি গড়ে তোলা হচ্ছে। এর মধ্যে গেট দিয়ে বিমানবন্দরে প্রবেশ হচ্ছে প্রথম ধাপ, দ্বিতীয় ইমিগ্রেশন, তৃতীয় ফাইনাল চেকিং এবং চতুর্থ এয়ারক্রাফটের প্রবেশ মুখ।এ চারটি স্তর অতিক্রম করতে হবে সংশ্লিষ্টদের।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সদস্য (অপারেশন অ্যান্ড প্ল্যানিং) এয়ার কমোডর মোস্তাফিজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ফ্লাইট পরিচালনার বিষয়ে অতিরিক্ত সতর্কতা (এক্সট্রা অ্যালার্ট) অবলম্বনের জন্য দেশের সব বিমানবন্দরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বেবিচকের ফ্লাইট সেফটি বিভাগ থেকে দেশি-বিদেশি এয়ারলাইন্স ও হেলিকপ্টার কোম্পানিগুলোর সঙ্গে জরুরি বৈঠকে করে এ নির্দেশ দেয়া হয়। তিনি বলেন, এখন থেকে সব ফ্লাইটের যাত্রী ও ক্রুদের চার স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনির মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
যাত্রীদের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি সব এয়ারলাইন্স ক্রুদেরও একইভাবে নিরাপত্তা বেষ্টনির মধ্য দিয়ে বিমানবন্দরে প্রবেশ করতে হবে। এসব নিরাপত্তা বেষ্টনির একটি স্তরে ডগ স্কোয়াড থাকবে। আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নসহ বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় নিয়োজিত অ্যাভসেক সেলকে আরও কঠোর মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হয়েছে। যাত্রী ও ক্রুদের প্রবেশপথেগুলোতে সিসি টিভি বসানো হয়েছে। সার্বক্ষণিকভাবে একটি মনিটরিং সেল থেকে সিসি টিভিগুলো পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এছাড়া কার্গো এরিয়ায় বিজিবির ডগ স্কোয়াড ও এক্সপ্লোসিভ ডিটেনশন সিস্টেম (ইডিএস) মেশিন বসানো হয়েছে। এ ইডিএস মেশিন দিয়ে যাত্রী ও কার্গো পণ্য শতভাগ এক্সরে স্ক্যানিং বা শতভাগ এক্সপ্লোসিভ ট্রেস ডিটেনশন (ইটিডি) মেশিনের মাধ্যমে তল্লাশি করা হবে।
এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বিদেশি এয়ারলাইন্সের কান্ট্রি ম্যানেজার যুগান্তরকে বলেন, শাহজালাল বিমানবন্দরসহ দেশের সব বিমানবন্দর ব্যবহারে তাদের অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ওই এয়ারলাইন্স কর্মকর্তা বলেন, প্রতিটি ফ্লাইট উড্ডয়নের আগে যাত্রী ও ক্রুদের ভালোভাবে তল্লাশি করতে বলা হয়েছে। ককপিটে সার্বক্ষণিকভাবে পাইলট ও কো-পাইলটের অবস্থান নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, পাইলট বা কো-পাইলটকে একা রেখে কেউ ককপিট ত্যাগ করতে পারবেন না। কোনো কারণে পাইলট বা কো-পাইলট ককপিটের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হলে সে সময় চিফ পার্সার বা প্রকৌশল বিভাগের কাউকে ককপিটে অবস্থান করতে হবে।
র্যাব সূত্রে জানা গেছে, উড়োজাহাজ চালিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন উড়িয়ে দেয়ার টার্গেট ছিল বিমানের কো-পাইলট সাব্বির এনামের। এ খবরে আতঙ্ক নেমে এসেছে বিমানে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইতিমধ্যে বিমানের ১৫ পাইলট ও কো-পাইলটকে ভয়ঙ্কর ক্যাপ্টেন হিসেবে উল্লেখ করে নজরদারি শুরু করেছে। এদের মধ্যে অনেকেই বিমান বাংলাদেশ পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) কার্যকরী কমিটির সদস্য ও বিমানের সিনিয়র পাইলট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য আছে, গাজীপুরের কালিয়াকৈরে বাপার একজন শীর্ষ নেতার বিশাল বাণিজ্যিক প্লট ব্যবসা আছে। এছাড়া সেখানে আছে আলিশান বাগানবাড়ি। ওই আবাসিক এলাকায় অনেক পাইলট প্লট কিনেছেন।
অভিযোগ আছে, জামায়াতের এক শীর্ষ নেতা ওই প্লট বেচাকেনা করেন। এ প্লট বিক্রির টাকা জঙ্গি অর্থায়নে ব্যয় হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা শুরু করেছেন গোয়েন্দারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে র্যাবের এক সদস্য যুগান্তরকে বলেন, গত ১০ বছর ধরে ওই বাপা নেতা ভিআইপি ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি পাননি। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইটে পাঠানোর জন্য যতবার তার নামে গোয়েন্দা ক্লিয়ারেন্স চাওয়া হয় ততবারই নেতিবাচক রিপোর্ট পাওয়া গেছে।
কিন্তু কিছুদিন আগে বিমান ম্যানেজমেন্ট তাকে প্রধানমন্ত্রীর একটি ফ্লাইটে যাত্রী হিসেবে যাওয়ার অনুমতি দেয়। এ নিয়ে পরে বিমানের পরিচালনা পর্ষদ চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল ইনামুল বারী, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসাদ্দিক আহম্মেদ ও পরিচালক ফ্লাইট অপারেশন ক্যাপ্টেন জামিল আহম্মেদ তোপের মুখে পড়েন। এরপরও থামেনি তার বিদেশ যাওয়া। গত ২ বছর ধরে রহস্যজনক কারণে বাপার শীর্ষ নেতা ওই পাইলটকে একাধিকবার বিভিন্ন ভিআইপি ফ্লাইটে পাঠানো হয়েছে।
গোয়েন্দারা এসব ফ্লাইটের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন। এছাড়া বাপার অপর এক শীর্ষ নেতার মা পাকিস্তানি নাগরিক বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য আছে। অভিযোগ, ওই পাইলট ও তার মা বছরে একাধিকবার পাকিস্তান যাতায়াত করেন। র্যাবের নিষেধাজ্ঞার পরও বাপার এ দুই শীর্ষ নেতা ও ফ্লাইট অপারেশনের এক কর্মকর্তার তদবিরে ম্যানেজমেন্ট কো-পাইলট সাব্বির এনামের গ্রাউন্ডেড আদেশ প্রত্যাহার করে তাকে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি দেন। এ ঘটনায় বিমানের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তার ঘনিষ্ঠজনও তদবির করেছেন বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য আছে।
অপর একটি সূত্র জানায়, বিমানের একজন পাইলটের বাবা মুক্তিযুদ্ধের সময় শান্তি কমিটির নেতা ছিলেন। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধিতাকারী এ পরিবারের এক সদস্যকে সম্প্রতি বিমানের ইনস্ট্রাকটর পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। যদিও একাধিকবার তিনি ইনস্ট্রাকটর পরীক্ষায় ফেল করেন।
র্যাব জানায়, বিমানের সিডিউলিং বিভাগের এক শীর্ষ কর্মকর্তা ও বাপা নেতার বাবার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের পক্ষে যুদ্ধ করার অভিযোগ আছে। জানা গেছে, ওই কর্মকর্তা মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হন। বিমান ম্যানেজমেন্ট এ তথ্য জানার পরও ওই ব্যক্তির ছেলেকে বিমানের সিডিউলিং বিভাগের শীর্ষ পদে পদোন্নতি দিয়েছেন। এ কর্মকর্তার পদটি এমনই গুরুত্বপূর্ণ তিনি ইচ্ছা করলে যে কোনো ফ্লাইটে, সরকারবিরোধী পাইলট ও কো-পাইলটকে পাঠাতে পারেন। অভিযোগ আছে, গ্রেফতারকৃত কো-পাইলট সাব্বির এনামকে র্যাবের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে দ্বিতীয় দফা ফ্লাইট দেয়ার সঙ্গে সিডিউলিং বিভাগের এ শীর্ষ কর্মকর্তার হাত রয়েছে।
এদিকে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) সূত্রে জানা গেছে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের নিরাপত্তার জন্য বৃহস্পতিবার যুক্তরাজ্য থেকে প্রশিক্ষিত ডগ স্কোয়াড আনা হয়েছে। এই স্কোয়াডে আটটি কুকুর আছে। এগুলোকে বৃহস্পতিবার বিকালে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামানো হয়।
এর মধ্যে ৪টি জার্মান শেফার্ড রয়েছে। কুকুরগুলোর নাম হচ্ছে- শেম, করি, ডিজেল, ডাই, বেক্স, বো, ফিন ও রক। বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক রাশিদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, কুকুরগুলো এক্সপ্লোসিভ ও ড্রাগ শনাক্তকরণে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত। এ ডগ স্কোয়াড এপিবিএনের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। তিনি বলেন, দেশের আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে ও ট্রেনিং শেষ হতে আরও ২ মাস সময় লাগবে। এরপরই এগুলো শাহজালালে নিযুক্ত করা হবে।
এদিকে প্রথম দিনের রিমান্ডে র্যাব জানতে পেরেছে, একটি জঙ্গি চক্র পাইলট সাব্বিরকে দিয়ে উড়োজাহাজ চালিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসভবন গুঁড়িয়ে দেয়ার টার্গেট করেছিল। একই সঙ্গে যাত্রীসহ একটি ফ্লাইট সিরিয়ার আইএস ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়ার টার্গেট করেছিল সাব্বির।
গুলশানে হলি আর্টিজানে হামলার আগে বা পরে গ্রেফতারকৃত আবদুল্লাহ, সাব্বির, ফরহাদ (সাংগঠনিক নাম সরোয়ার জাহান) এ পরিকল্পনা করেছিল। র্যাব জানতে পেরেছে, এ ঘটনার সঙ্গে বিএনপির একজন শীর্ষ নেতার ভাই যিনি এক সময় বিমানের ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত ছিলেন তারও সম্পৃক্ততা রয়েছে। গুলশানের একটি মসজিদে তিনি ও বিমানের এক পাইলট প্রায়ই নামাজ পড়েন। নামাজ শেষে তাদের দীর্ঘ সময় মসজিদের ভেতর ও বাইরে কথা বলতে দেখেছেন গোয়েন্দারা।