আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে মিয়ানমারে সাধারণ মানুষের

0
DBN miyanmar

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

মিয়ানমারের গণ-বিক্ষোভ যেভাবে সহিংসতার সঙ্গে দমন করা হচ্ছে তার মধ্যে প্রতিদিন সাধারণ মানুষকে অনেক ধরণের কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।দিনের পর দিন বিক্ষোভ-প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে ।

গত ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক বাহিনী দেশের পুরো ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর থেকেই বিক্ষোভের সূত্রপাত। গত বছরের নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে এমন অভিযোগ তুলে সামরিক বাহিনী এই অভ্যুত্থান ঘটায়। বিক্ষোভকারীরা চাইছে তাদের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বেসামরিক সরকারকে পুনর্বহাল করা হোক।

জাতিসংঘের হিসেবে, গত ১ ফেব্রুয়ারি আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হওয়ার পর এ পর্যন্ত অন্তত ১৪৯ জন নিহত হয়েছে। তবে নিহতের প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে বেশি হতে পারে। মিয়ানমারে প্রতিদিন যারা রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছেন সে সব আত্মত্যাগী বেশ কয়েকজনের কাহিনী সামনে এসেছে।

জেনারেল স্ট্রাইক কমিটি অব ন্যাশনালিটিজ নামে একটি সংগঠনের নেতা ইয়ান ন’। তিনি বলেন, নিজের এক বছর বয়সী মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই তিনি বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছেন। তিনি তার মেয়ের জন্য একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ আশা করেন। তিনি বলেন, ‘আমি মিয়ানমারের সংখ্যালঘু কারেন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। কাজেই এরকম বিক্ষোভ আমার কাছে নতুন কিছু নয়।’ আজকের বিক্ষোভকারীরা স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি এবং প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টের মুক্তি এবং ২০২০ সালের ভোটের ফল বহাল করার দাবি জানাচ্ছে। কিন্তু যারা সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর মানুষ, তাদের দাবিগুলো আরও গভীরতর। তারা এমন এক ফেডারেল গণতান্ত্রিক দেশ চায় যেখানে মিয়ানমারের সব জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জায়গা থাকবে। সামরিক বাহিনী বহু বছর ধরেই মিয়ানমারের মানুষকে বিভক্ত করে শাসনের কৌশল নিয়েছিল। কিন্তু এখন সব জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ একত্র হয়েছে। তিনি বলেন, আমার এক বছর বয়সী একটা ছোট্ট মেয়ে আছে। আমার কাজের কারণে ওকে ভুগতে হোক এটা আমি চাই না। আমি এই বিক্ষোভে শামিল হয়েছি, কারণ আমি চাই না যে রকম স্বৈরতন্ত্রের অধীনে আমরা বেড়ে উঠেছি, ওর বেলাতেও সেটাই ঘটুক। এই বিক্ষোভে যোগ দেয়ার আগে এটা নিয়ে আমি আমার স্বামীর সঙ্গে কথা বলেছি। তাকে বলেছি বলেছি, যদি আমাকে গ্রেফতার করা হয় বা এই বিক্ষোভে আমার মৃত্যু হয় ও যেন আমাদের মেয়েকে দেখাশোনা করে, যেন জীবন চালিয়ে নেয়। আমরা আমাদের জীবনেই এই বিপ্লব শেষ করে যাব এবং আমাদের সন্তানদের জন্য এই কাজ রেখে যাব না।

নন্দ কাজ করেন মায়িক শহরের এক হাসপাতালে। তিনি মিয়ানমারের এই বিক্ষোভের একেবারে সামনের কাতারে সামিল হয়েছেন। কিন্তু নন্দ বলছেন, সামরিক বাহিনী ধরে নিয়ে যেতে পারে এমন ভয়ে মায়িকের বিক্ষোভকারীদের লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে। তিনি ৭ মার্চের সন্ধ্যার কথা মনে করছিলেন। সে সময় সবেমাত্র কারফিউ বলবৎ হতে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমি আমার গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছি, গাড়ির জানালায় কালো কাঁচ। আমি, একজন অর্থোপেডিক সার্জন, তার স্ত্রী, এক চিকিৎসক এবং তার পরিবারকে তুলে নেই। রাতের অন্ধকারে আমরা তাদের ব্যাগ গাড়িতে তুলি এরপর একটা নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেই ‘এর মাত্র একদিন আগে সরকারি কর্মকর্তারা মায়িকের হাসপাতালগুলোতে এসে বিক্ষোভে অংশ নেয়া বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, মেডিকেল অফিসার এবং নার্সদের নাম জানতে চায়। তখন আমাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এরা কেন সবার নাম জানতে চাচ্ছে? যদি কর্মকর্তাদের কাছে এদের ডাক পড়ে, তখন কি হবে? যেসব ডাক্তার সরকারি চাকরি করেন, তারা সিদ্ধান্ত নিলেন সবাই আত্মগোপনে যাবেন। ধরা পড়লে কি ঘটবে সেটা নিয়ে তাদের মনে অনেক শঙ্কা। আমার ওপর দায়িত্ব পড়লো কিছু ডাক্তারকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করার। আমার গাড়ির ভেতরে তখন থমথমে পরিবেশ। যা ঘটছে তা কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না, সবাই তীব্র ক্ষোভে ফুঁসছে। একজন ডাক্তার বলছিলেন, ‘ওরা যখন তাদের ইচ্ছেমত যা খুশি করে যাচ্ছে তখন আমাদের মতো লোকজনকে (ডাক্তার এবং মেডিকেল কর্মী) কেন অপরাধীদের মতো লুকিয়ে থাকতে হবে।’ আমি কোনদিন ভাবিনি আমাকে কোনদিন এভাবে ডাক্তারদের লুকিয়ে রাখতে হবে, যারা কেউ কোন অপরাধ করেনি। আগামীকাল থেকে মায়িকের মানুষের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে কেবল অল্প কয়েকজন চিকিৎসকই থাকবেন। সেনাবাহিনীর লোকজন পিটিয়ে যেসব বিক্ষোভকারীদের আঙ্গুল বা হাত ভেঙ্গে দিচ্ছে, মাথা ফাটিয়ে দিচ্ছে, তাদের চিকিৎসার জন্য যথেষ্ট সংখ্যায় সার্জন হাসপাতালে থাকবে না। মায়িকের হাসপাতালে একজনও শিশু চিকিৎসক বা স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ থাকবে না। এই আন্দোলনের এক বড় শক্তি ছিল মেডিকেল কর্মীরা। এখন তাদেরও চলে যেতে হলো।

মং একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা। তিনি ইয়াঙ্গুনে থাকেন। যখন বিক্ষোভ শুরু হলো তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন প্রতিটি দিন তিনি ধরে রাখবেন, যাতে করে বোঝা যায় কীভাবে এই আন্দোলন গড়ে উঠছে। তিনি বলেন, ২৮ ফেব্রুয়ারির ছিল অবিস্মরণীয় একটি দিনি। সেদিন আমি ছিলাম ইয়াঙ্গুনের বারগায়া স্ট্রিটে, ব্যারিকেডের পেছনে একেবারে সবার সামনের কাতারে। আমি আমার ফোন দিয়ে ভিডিও করছিলাম। শত শত বিক্ষোভকারী তখন শ্লোগান দিচ্ছে এবং বোতল এবং ক্যান বাজিয়ে শব্দ করছে। হঠাৎ প্রায় একশ জনের মতো লোক আমাদের দিকে এগিয়ে এলো। আমি বুঝতে পারছিলাম না এরা পুলিশ নাকি সেনা সদস্য। কোন সতর্কতা ছাড়াই তারা আমাদের দিকে সাউন্ড বোমা, গুলি এবং কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়তে শুরু করলো। ছবি তোলা শুরু করার আগেই আমি পালানোর একটা পথ ঠিক করে রেখেছিলাম। আমি সেই রাস্তাটার দিকে দৌড়ে গেলাম, তবে একই সঙ্গে আমি আমার ফোনে ভিডিও রেকর্ড করে যাচ্ছিলাম। আমাদের বেশিরভাগই সেদিন পালাতে পেরেছিলাম। এখন আমি যখন কোন বিক্ষোভে যাই, আমাকে সাথে আগুন নিরোধী দস্তানা এবং একটা হেলমেট রাখতে হয়। আমরা পুলিশের ছোঁড়া কাঁদানে গ্যাস সুযোগ পেলে পাল্টা তাদের দিকেই ছুঁড়ে মারার চেষ্টা করি। অনেক সময় আমরা কাঁদানে গ্যাসের শেল বিকল করতে এর ওপর ভেজা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেই এবং তারপর পানি ঢেলে দেই। অনেকে সস্তা গ্যাস মাস্ক পরে, তবে গ্যাস থেকে তা পুরোপুরি রক্ষা করতে পারে না। আমরা দেখেছি, মুখে গ্যাস লাগলে তা ধুয়ে ফেলতে ঠাণ্ডা পানীয় কোক খুব কাজ দেয়। একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং বিক্ষোভকারী হিসেবে আমি প্রতিদিনই বিক্ষোভে অংশ নিয়ে প্রতিদিনই একটি শর্ট ফিল্ম বানানোর সিদ্ধান্ত নেই। এখন যখন আমি এসব ভিডিও দেখি, তখন আমি বুঝতে পারি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ বিক্ষোভ এখন কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে, আমাদের জীবনের জন্য কতটা ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এটি আসলে একটি ফিল্মের চেয়েও বেশি অদ্ভুত।

ফিও একজন গবেষক। আরও ২শ বিক্ষোভকারীর সঙ্গে তিনি ইয়াঙ্গুনের দক্ষিণের এক জেলা সানচুয়াংয়ের এক বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছিলেন। তখন তাদের কোণঠাসা করে ফেলে সামরিক বাহিনী। তাদেরকে সেখান থেকে যেতে দেয়া হচ্ছিল না। সেখান থেকে অন্তত ৪০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। সেদিন ছিল ৮ মার্চ। নিরাপত্তা বাহিনী এলো তখন দুপুর প্রায় দুইটা। ওরা এসে আমাদের আটকে ফেললো। তখন আমরা দেখলাম, বিভিন্ন বাড়ির লোকজন দরজা খুলে এবং হাত নেড়ে তাদের ওখানে যেতে বলছে। নিরাপত্তা বাহিনী বাইরে অপেক্ষা করছিল কখন আমরা বেরুবো। আমরা একটা বাড়িতে সাতজন ছিলাম। ছয়জন নারী, একজন পুরুষ। বাড়িতে লোকজন ছিল বেশ দয়ালু, ওরা আমাদের খাবার খেতে দিল। আমরা ভেবেছিলাম কয়েক ঘণ্টা পরে বেরুলে কোন অসুবিধা হবে না। কিন্তু সাড়ে ছয়টা নাগাদ আমরা চিন্তিত হয়ে পড়লাম। আমরা বুঝতে পারলাম, নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন সেখান থেকে যাবে না। তখন আমরা পরিকল্পনা করছিলাম কিভাবে পালানো যায়। বাড়ির লোকজন আমাদের বলল, কোন রাস্তা দিয়ে নিরাপদে লুকিয়ে পালানো যাবে, কোথায় কোথায় লুকিয়ে থাকা যাবে। আমরা আমাদের জিনিসপত্র প্রথম আশ্রয়দাতা বাড়ির মালিকের কাছে রেখে গেলাম। আমি একটা সারং পড়লাম যাতে আমাকে দেখতে স্থানীয় কোন মানুষের মতো লাগে, তারপর ঘর থেকে বেরুলাম। আমি আমার ফোন থেকে অনেক অ্যাপ আন-ইনস্টল করলাম। কিছু নগদ টাকা নিলাম। আমরা একটা পুরো রাত আরেকটা নিরাপদ আশ্রয়ে ছিলাম। সকালে আমরা শুনলাম নিরাপত্তা বাহিনী আর সেখানে নেই।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *