ভ্যাট ১২% করার প্রস্তাব সিপিডির

আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকর হতে যাওয়া নতুন মূল্য সংযোজন কর আইনে ভ্যাটের হার ১২ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। নতুন ভ্যাট আইনে সরকার সব ধরনের পণ্য ও সেবার ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট বসানোর পরিকল্পনা করলেও সিপিডি বলেছে, ১৫ শতাংশের পরিবর্তে ভ্যাট হার ১২ শতাংশে নামিয়ে আনা উচিত। একেবারে না পারলে ধাপে ধাপে এটি করা যেতে পারে বলে পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। সরকার চলতি অর্থবছর মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭.২৪ শতাংশ অর্জনের যে প্রাক্কলন করেছে, সে প্রাক্কলন নিয়ে প্রশ্ন তুলে সিপিডি বলেছে, বর্তমান বাস্তবতায় প্রবৃদ্ধির এই প্রাক্কলন অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
গতকাল শনিবার রাজধানীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সিপিডি আরো বলেছে, ব্যাংকিং খাত এখন নীরব ক্যান্সারে আক্রান্ত। এই ক্যান্সার থেকে ব্যাংকিং খাতকে উদ্ধার করতে সাময়িকভাবে একটি শক্তিশালী ব্যাংকিং কমিশন গঠন করার দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি।
চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাংলাদেশের অর্থনীতির তৃতীয় অন্তর্বর্তীকালীন পর্যালোচনা তুলে ধরতে গতকাল শনিবার সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সিপিডি। তাতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম খান। এ সময় বক্তব্য দেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, ড. মোস্তাফিজুর রহমান, সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
সব ধরনের পণ্য ও সেবার ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা নিয়ে আপত্তি আছে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের। তাদের মতে, ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট নির্ধারণ করলে চাপ পড়বে ভোক্তার ওপর। উসকে দেবে মূল্যস্ফীতি। ভ্যাটের হার কমানো নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছে ব্যবসায়ীরা। কিন্তু পরিস্থিতির কোনো সুরাহা হয়নি এখনো। এমন পরিস্থিতিতে সংসদে বাজেট উপস্থাপনের আগে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে সিপিডি দাবি তুলেছে, ভ্যাট হার ১২ শতাংশ করা উচিত। আসছে বাজেটে সিমেন্ট, টেলিকম জাতীয় সেবা ও পেট্রোলিয়াম জাতীয় পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক না বসানোর প্রস্তাব করেছে সংস্থাটি। এ ছাড়া স্থানীয় শিল্পের সুরক্ষায় সম্পূরক শুল্ক বহাল রাখার দাবিও জানিয়েছে গবেষণা সংস্থাটি। পাশাপাশি আয়করের নিম্নস্ত ১০ শতাংশের পরিবর্তে ৭ শতাংশ করার সুপারিশ করেছে সিপিডি।
সরকারের প্রাক্কলিত জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে কেন সন্দেহ করছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘যে কয় মাসের তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জিডিপির প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করেছে তাতে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি কমেছে; ম্যানুফ্যাকচারিং খাতেরও প্রবৃদ্ধিও কমেছে। এ সময়ে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের গতিও কমতির দিকে। সরকারি বিনিয়োগ বাড়লেও বেসরকারি বিনিয়োগ মোটামুটি স্থবির। রাষ্ট্রের ভোগ বাড়লেও ব্যক্তি খাতের ভোগ কমেছে। আশানুরূপ কর্মসংস্থানও হয়নি। এসব সূচক নিম্নমুখী হওয়া সত্ত্বেও প্রবৃদ্ধি কিভাবে ৭.২৪ শতাংশ প্রাক্কলিত হয় তাই নিয়েই প্রশ্ন। ’
দেবপ্রিয় বলেন, অনুমান ও তথ্যের অভিগম্যতার অতিমাত্রায় প্রবৃদ্ধিনির্ভর উন্নয়ন আলোচনা অত্যন্ত খণ্ডিত ও অসম্পূর্ণ। প্রবৃদ্ধিনির্ভর এই বিতর্ক অনেক ক্ষেত্রেই অবাস্তব। তার চেয়ে আলোচনা হওয়া দরকার কর্মসংস্থান নিয়ে। কর্মসংস্থানকে বাদ দিয়ে প্রবৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা করা অর্থহীন। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, শিল্পের উন্নতি হচ্ছে তাহলে সে হারে কর্মসংস্থান হচ্ছে না কেন।
দেবপ্রিয় অভিযোগ করেন, ‘নির্বাচনকে সামনে রেখে অর্থপাচারের প্রবণতা বাড়ছে। আমাদের দেশের উদ্যোক্তারা নিজের দেশে বিনিয়োগ না করে আফ্রিকার অনেক দেশে বিনিয়োগে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। এটা একটা বড় সংকেত। ব্যাংকিং খাতে নিরব ক্যান্সার চলছে উল্লেখ করে দেবপ্রিয় বলেন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে সরকার ব্যাংক কম্পানি আইন সংশোধন করেছে। মন্দ ঋণ বাড়ছে। ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। সেখানে সুশাসনের অভাব আছে। চলছে অনিয়ম ও দুর্নীতি। এসব প্রতিরোধে একটি শক্তিশালী ব্যাংকিং কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেন তিনি। যে কমিশন হবে সাময়িক। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকে পরিচালনা পর্ষদে যে পরিবর্তন এসেছে, সেটিকে সিপিডি কিভাবে দেখছে—সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে ফাহমিদা খাতুন বলেন, এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় বাংকের ভূমিকা নেওয়া জরুরি ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো ভূমিকা দেখতে পারছি না।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোতেও সুশাসনের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছে। নতুন করে মন্ত্রিসভায় ব্যাংক কম্পানি আইন পাস হওয়ার মধ্য দিয়ে বেসরকারি খাতের ব্যাংকে পরিবারতন্ত্রে রূপ নেবে। পরিবারের সিদ্ধান্তের বাইরে কোনো কিছুই করা সম্ভব হবে না। এতে করে সুশাসনের আরো অবনতি হবে।
মূল প্রবন্ধে তৌফিকুল ইসলাম খান দেখিয়েছেন, চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত যে হারে রাজস্ব আদায় চলছে, তাতে বছর শেষে মূল লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩৮ হাজার কোটি টাকা কম আদায় হবে। ফলে এবারও বাজেটের দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। আসছে বাজেটে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর দাবি করেছেন তৌফিকুল ইসলাম খান। তিনি আরো বলেন, দেশে অর্থপাচারের হার বাড়ছে। এটি রোধ করতে ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল ও বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে শক্তিশালী করার পরামর্শ দেন তিনি। এখন থেকে ত্রৈমাসিক মূল্যস্ফীতির হার দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় তার সমালোচনা করে সিপিডি বলেছে, এতে করে এখন তথ্যপ্রাপ্তির যে অভিগম্যতা সেটি আরো কঠিন হবে। এটি সরকারের নেতিবাচক সিদ্ধান্ত বলে অভিহিত করেছে সংস্থাটি। সাম্প্রতিক সময়ে হাওরাঞ্চলে বোরোর ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে একটি তথ্য দিয়ে তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, হাওরাঞ্চলে আগাম বন্যার কারণে ১৬ লাখ টন বোরো ধানের ক্ষতি হয়েছে। যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৮ শতাংশ। বাংলাদেশে উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় এত বেশি কেন তা নিয়েও গতকাল সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন তুলেছে সিপিডি।
তাতে বলা হয়েছে, ভারতে এক কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে খরচ হয় ১২ থেকে ১৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশে সেটি তিন গুণ কখনো চার গুণ বেশি খরচ হয়। অন্য দেশে এক টাকা খরচ করলে সে মুনাফা হয়, বাংলাদেশে তা হয় না। প্রকল্পের খরচকে যৌক্তিক করতে একটি শক্তিশালী পর্যালোচনা কমিশন গঠনের দাবি করেছে সংস্থাটি। একই সঙ্গে বাজেটের গুণগত মান নিশ্চিত করার পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে তথ্য পাওয়া আরো সহজ করার দাবি করেছে সিপিডি। পুঁজিবাজারে যেসব সংস্কারের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়নেরও তাগিদ দিয়েছে সিপিডি।