মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ প্রকাশ্যে আইনবর্হিভূত ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে

সমিতির আড়ালে ‘দ্য মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ সোসাইটি’ ব্যাংকিং কার্যক্রম চালালেও সেটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রচলিত আইনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সে সক্ষমতা নেই। তবে এ ব্যাপারে সমবায় অধিদফতর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কিন্তু সমবায় অধিদফতর এর আগে ওই প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েও তাকে বসাতে পারেনি। কারণ কোনো কিছু তোয়াক্কা না করেই মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ প্রকাশ্যে আইনবর্হিভূত ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
অবৈধভাবে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার দায়ে সম্প্রতি মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ সোসাইটির বিরুদ্ধে ‘বিধিগত’ ব্যবস্থা নিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সচিবকে সম্প্রতি চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদকের চিঠির পর ব্যবস্থা নেয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা যুগান্তরকে বলেন, ওই প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে ব্যাংকিং করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে তা ধরা পড়ার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সমবায় অধিদফতরকে বলা হয়েছে। বিষয়টি সরকারকে অবহিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে সরকার ও সমবায় অধিদফতর বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এরপরও প্রতিষ্ঠানটি ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ না করলে আসন্ন এ সংক্রান্ত একটি বৈঠকে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
অন্য একটি সূত্র জানায়, মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সমবায় অধিদফতরকে কেবল সুপারিশ করতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা বন্ধ করার নিজস্ব আইন ও সক্ষমতা নেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। সমবায় সমিতির কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্য নিয়ে গঠন করা হয় দ্য মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ সোসাইটি। কিন্তু সমিতির আড়ালে সম্পূর্ণ ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। ইতিপূর্বে এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগ আনা হয়।
উচ্চ সুদ বা মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে সারা দেশে ১২০টি শাখার মাধ্যমে দেড় লাখ গ্রাহক থেকে আমানত সংগ্রহ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। মাত্র তিন কোটি টাকার শেয়ার মূলধনের বিপরীতে এক হাজার কোটি টাকার আগ্রাসী আমানত সংগ্রহের চিত্র ওঠে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে।
সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েছেন দুদকের সচিব ড. মো. শামসুল আরেফিন। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, দ্য মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ সোসাইটি ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে শাখা ও উপ-শাখা খুলে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এ প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে ‘বিধিগত’ ব্যবস্থা নিতে পারে বলে কমিশন মনে করে। চিঠিতে আরও বলা হয়, দুদক প্রতিষ্ঠানের নথিসহ অন্য বিষয়ে অনুসন্ধান করেছে। তদন্তে দেখা গেছে, সমবায় অধিদফতর থেকে ১৯৭৩ সালে ‘দ্য বেঙ্গল কো-অপারেটিভ সোসাইটি অ্যাক্ট, ১৯৪০’-এর বিধান অনুযায়ী সমবায় প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি নিবন্ধন নিয়েছে। এটি বাংলাদেশ ব্যাংক বা ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ অনুযায়ী কোনো ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধিত নয়। ১৯৮৯ সালে সমবায় অধিদফতর থেকে প্রতিষ্ঠানটির নামের শেষে ‘ব্যাংক’ শব্দ ব্যবহার না করার নির্দেশ দেয়া হয়। এরপরও প্রতিষ্ঠানটি ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
জানা গেছে, অবৈধ ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি ১৫ বছর ধরে আমানত সংগ্রহ করছে। এরমধ্যে সাড়ে ৯০০ কোটি টাকার ওপরে আমানত সংগ্রহ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ কিংবা দেউলিয়া হলে দেড় লাখ গ্রাহক পথে বসবে। সূত্র মতে, দ্য মার্কেন্টাইলের ব্যাংকিং বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত করে দেখতে পায় ২০০১ সালে এর আমানত ছিল এক কোটি এবং বিনিয়োগ ছিল ৫৩ লাখ টাকা। অথচ ২০১৫ সালে এসে এর আমানত ৯৮১ কোটি ও বিনিয়োগের পরিমাণ এক হাজার ৮০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। সে হিসাবে সমিতির আমানত ৯১৬ গুণ ও বিনিয়োগ দুই হাজার ৩৬ গুণ বেড়েছে। প্রতিষ্ঠানের উপবিধির ১৮ ধারা অনুযায়ী প্রতি সদস্যের অনুকূলে ন্যূনতম ১০০ টাকার শেয়ার বিতরণ করলেও সর্বনিন্ম শেয়ার মূলধন ২০ কোটি টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, এতে সুস্পষ্ট প্রমাণিত যে, প্রতিষ্ঠানটি সদস্যবহির্ভূত সাধারণ গ্রাহক থেকেও ব্যাংকের মতো আমানত সংগ্রহ করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে আরও বলা হয়, এসব আমানতের বেশির ভাগই দীর্ঘ মেয়াদি আমানত প্রকল্পের মাধ্যমে সংগৃহীত। প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক আমানত বৃদ্ধির হার প্রায় ২৬ শতাংশ। পাঁচ বছরে আমানত বৃদ্ধির হার প্রায় ১২০ শতাংশ- যা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর আমানত বৃদ্ধির হারের তুলনায় অস্বাভাবিক। প্রতিষ্ঠানটির এ আগ্রাসী আমানত সংগ্রহ কার্যক্রম বন্ধ করা না গেলে উচ্চ মুনাফার প্রলোভনে আরও বিপুলসংখ্যক গ্রাহকের আমানত ঝুঁকিগ্রস্ত হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে ওঠে এসেছে।