আমিনবাজারে ৪২.৫ মেগাওয়াট বর্জ্যভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র অবিলম্বে বাতিলের গণরায়
আল মায়ামী: রবিবার সাভার বলিয়াপুর বনগাঁও ইউনিয়নের নগরকোন্ডা, কোন্ডা স্কুল মাঠে সকাল ১১ ঘটিকায় অনুষ্ঠিত এক গণশুনানি থেকে সর্বসম্মতিক্রমে ঘোষণা করা হয়েছে যে, সাভারের আমিনবাজারে নির্মাণাধীন নর্থ ঢাকা ৪২.৫ মেগাওয়াট বর্জ্যভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র একটি ভুল, ঝুঁকিপূর্ণ ও জনস্বার্থবিরোধী প্রকল্প, যা অবিলম্বে বাতিল করা জরুরি। গণশুনানিতে পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকল্পটির ভয়াবহ ঝুঁকি তুলে ধরা হয়। স্থানীয় বাসিন্দা, নারী, যুবসমাজ, বর্জ্য সংগ্রাহক, ভূমি মালিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য পর্যালোচনা করে সর্বসম্মতিক্রমে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া হয় যে, এই প্রকল্প ঢাকার মানুষের জীবনের ওপর একটি পরিকল্পিত স্বাস্থ্যঝুঁকি চাপিয়ে দেবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকার হরণ করবে।
উক্ত গণশুনানিতে ধারনাপত্র উপস্থাপন করেন উপকূলীয় জীবনযাত্রা ও পরিবেশ কর্মজোট (ক্লিনের) প্রচারাভিযান কর্মকর্তা মোহাম্মদ নোমান। উপস্থাপিত তথ্যানুযায়ী, এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রতি ইউনিট মূল্য প্রায় ২৫.৫৬ টাকা, যেখানে বর্তমানে দেশের গড় বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ প্রায় ১২ টাকা। অর্থাৎ সরকারকে দ্বিগুণ দামে বিদ্যুৎ কিনতে হবে, যার বোঝা শেষ পর্যন্ত পড়বে জনগণের কর ও বিদ্যুৎ বিলের ওপর। নোমান বলেন, “এটি পরিচ্ছন্ন জ্বালানির নামে সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও নোংরা বিদ্যুৎ।”
ধারনাপত্র অনুযায়ী, ২৫ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের জন্য সরকারের মোট ব্যয় দাঁড়াবে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি, যা শতভাগ বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করতে হবে। যখন দেশ তীব্র ডলার সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন এমন একটি ব্যয়বহুল চুক্তি গ্রহণ করা অর্থনীতিকে আরও দুর্বল ও অনিশ্চিত করে তুলবে।
গণশুনানিতে তুলনামূলক বিশ্লেষণে স্পষ্ট হয়েছে যে, আমিনবাজারে স্থাপিত ৪২.৫ মেগাওয়াট বর্জ্যভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চরমভাবে ব্যয়বহুল ও অদক্ষ। প্রতি মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় প্রায় ১১ মিলিয়ন ডলার, যেখানে সৌরবিদ্যুতে একই সক্ষমতা তৈরি করা যায় মাত্র ০.৭-১ মিলিয়ন ডলারে। একই অর্থে ২২ গুণেরও বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব ছিল। মোট ৪৬৭ মিলিয়ন ডলার রুফটপ সোলারে বিনিয়োগ করলে প্রায় ৯৩২ মেগাওয়াট, গ্রাউন্ড-মাউন্টেড সৌরবিদ্যুৎ থেকে ৪৬৬ মেগাওয়াট, এবং বায়ু বিদ্যুতে ৩২১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হতো। এটি প্রমাণ করে প্রকল্পটি অর্থনৈতিকভাবে অযৌক্তিক ও লোকসানমুখী। আইনি ও স্বচ্ছতার দিক থেকেও এ প্রকল্পটি প্রশ্নবিদ্ধ যেমন- পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব মূল্যায়ন ও প্রকাশ করা হয়নি, জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি মূল্যায়ন অনুপস্থিত, এবং টেন্ডার ছাড়াই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের জন্য বর্জ্য সরবরাহ ব্যর্থ হলে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনকে জরিমানা দিতে হবে, যা শহরের আর্থিক স্থিতিশীলতাকে দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকিতে ফেলে।
উক্ত গণশুনানিতে উপস্থিত বক্তারা বলেন, ঢাকা শহর ইতোমধ্যেই ভয়াবহ বায়ুদূষণের শিকার। এমন বাস্তবতায় ঘনবসতিপূর্ণ আমিনবাজার এলাকায় প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার টন বর্জ্য পোড়ানোর পরিকল্পনা মানে মানুষের শ্বাস নেওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া। এই ইনসিনারেশন প্ল্যান্ট থেকে নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইড, ডাইঅক্সিন, ফিউরান ও সূক্ষ্ম কণা শিশু, নারী, বৃদ্ধ ও গর্ভবতী নারীদের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করবে। বক্তারা আরও বলেন, ঢাকার বর্জ্য এখনো উৎসে পৃথকীকরণ ছাড়াই সংগ্রহ করা হয়। এতে বর্জ্যের আর্দ্রতা বেশি এবং জ্বালানিমান অত্যন্ত নিম্ন। এই ধরনের বর্জ্য দিয়ে কার্যকর বিদ্যুৎ উৎপাদন বাস্তবে প্রায় অসম্ভব। ফলে প্রকল্পটি শুরু থেকেই প্রযুক্তিগত ব্যর্থতার ঝুঁকিতে রয়েছে।
গণশুনানির চূড়ান্ত দাবি
গণশুনানি থেকে সর্বসম্মতিক্রমে নিম্নোক্ত সরাসরি ও বাধ্যতামূলক দাবিগুলো উত্থাপন করা হয়-
১. ঢাকা নর্থ ৪২.৫ মেগাওয়াট WTE প্রকল্প অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।
২. প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও বিলম্বের কারণে প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নির্মাণ পরিকল্পনা স্থগিত ও বাতিল করতে হবে।
৩. প্রকল্পের Power Purchase Agreement (PPA) অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।
৪. AIIB এবং NDB-এর সকল অর্থায়ন প্রকল্প থেকে প্রত্যাহার করতে হবে।
৫. ঢাকার জন্য কার্যকর, বিজ্ঞানভিত্তিক এবং টেকসই Waste Management Plan এবং Renewable Energy Master Plan প্রণয়ন করতে হবে।
৬. পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের প্রভাব নিয়ে জনগণের মতামত ও সম্মতি বাধ্যতামূলকভাবে নিতে হবে।
৭. ভবিষ্যতে কোনো বিদ্যুৎ বা অবকাঠামো প্রকল্পে টেন্ডার ও স্বচ্ছতার নিয়ম এড়ানো যাবে না; সকল প্রক্রিয়া জনস্বার্থ ও জবাবদিহির ভিত্তিতে সম্পন্ন হতে হবে।
গণশুনানি কার্যক্রম সঞ্চালনা করেন প্রতিষ্ঠাতা-স্টার্ট টু স্কেলআপ এবং ফর দ্যা লাইট আলামিন প্রান্ত। গণশুনানির কীনোট বক্তব্য প্রদান করেন ক্যাম্পেইন অফিসার-ক্লিন জনাব মো. নোমান। গণশুনানিতে স্থানীয় ভুক্তভোগী হিসাবে সাক্ষ্য প্রদান করেন রাখেন ড. শাহিন, ইমরান মোল্লা, আল আমিন, এনামুল এবং রবিন। গণশুনানির বিচারকার্য পরিচালনা করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-এর যুগ্ম সম্পাদক মিহির বিশ্বাস, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ বাংলাদেশ এর প্রভাষক এবং আইপিডি এর রিসার্চ ফেলো কে. এম. আসিফ ইকবাল আকাশ, অত্র এলাকার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং কুন্ডা আইডিয়াল স্কুলের অধ্যক্ষ মো. শাহদাত হোসেন, স্টাফ রিপোটার-দৈনিক মুক্তখবর এর লেখক কবি আল-মায়ামী, নির্বাহী পরিচালক- শিল্ড মো. মাহবুব আলম। তারা স্থানীয় জনগণ, পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে তাদের অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। স্থানীয়দের সর্বসম্মতির ভিত্তিতে গণশুনানির প্রধান বিচারক এই রায় ঘোষনা দেন যে, উন্নয়নের নামে স্থানীয়রা বর্জ্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র চায় না; তারা চায় সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ, পরিষ্কার বাতাস এবং ন্যায্য, নিরাপদ ভবিষ্যৎ। এই গণমুখী এবং যুক্তিসম্পন্ন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নর্থ ঢাকা (আমিনবাজার) ৪২.৫ মেগাওয়াট বর্জ্যভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। গণশুনানির সমাপনী বক্তব্য প্রদান করেন ফাইনান্স এন্ড এডমিন কোর্ডিনেটর- ক্লিন মোস্তাফিজুর রহমান রাসেল।
