এমসি কলেজ হোস্টেল আগুন ২৯ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা
সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে অগ্নিসংযোগকারীদের চিহ্নিত করেছে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি। বহুল আলোচিত এ ঘটনায় চিহ্নিত ২৯ জনের মধ্যে অধিকাংশই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিলের পর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। সিলেটের অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন আদালতের বিচারক উম্মে সরাবন তহুরা বৃহস্পতিবার গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। এর আগে বুধবার সিলেটের চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক সাইফুজ্জামান হিরোর আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি। প্রতিবেদনের পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, ছাত্রাবাস পোড়ানোর ঘটনার মামলার সাক্ষীদের মৌখিক সাক্ষ্য, ভিডিও ফুটেজ, স্থিরচিত্রসহ প্রয়োজনীয় সব তথ্য-আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। সার্বিক পর্যালোচনায় প্রমাণিত হয়, ছাত্রলীগ ও ছাত্র শিবিরের বিরোধের কারণেই ছাত্রাবাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। ছাত্রলীগের কর্মী উজ্জ্বল আহমদকে ছাত্র শিবিরের কর্মীরা গুরুতর জখম করায় তাৎক্ষণিক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পরে ছাত্রাবাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়। আগুন দেয়ার সময় দুর্বৃত্তরা গ্যালনের পেট্রোল ব্যবহার করে।
শাহপরান থানার ওসি আখতার হোসেন যুগান্তরকে জানান, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে বলে শুনেছি তবে এ সংক্রান্ত কোনো নথি পাইনি। চিফ মেট্রোপলিটন আদালতের বেঞ্চ সহকারী আইয়ুব আলী তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, এমসি কলেজের ছাত্রাবাস পোড়ানোর ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি ২৯ জনের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছে। তিনি জানান, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার বিকালে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। শিগগির পরোয়ানার কপি সংশ্লিষ্ট থানায় পৌঁছে যাবে।
তদন্ত প্রতিবেদনে যে ২৯ জনের নাম রয়েছে তারা হলেন- সিলেট সরকারি কলেজ শাখার তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি ও বর্তমানে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক দেবাংশু দাস মিঠু, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক (বরখাস্ত) সভাপতি পংকজ পুরকায়স্থ, আবু সরকার (বহিরাগত, শ্রমিক লীগের সাবেক সভাপতি), জাহাঙ্গীর আলম (জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক), মৃদুল কান্তি সরকার, কামরুল ইসলাম, আলমগীর হোসেন (সাবেক ছাত্রলীগ নেতা, বর্তমানে আইনজীবী ও বিশ্বনাথ উপজেলার রামপাশা ইউপি চেয়ারম্যান), বাবলা, মো. আতিকুর রহমান, লায়েক আহম্মেদ, সিদ্দিক আহম্মেদ ইউসুফ, জহিরুল ইসলাম, আক্তারুল ইসলাম, জসিম উদ্দিন, আসাদুজ্জামান শাহিন, মোহাম্মদ বিন মামুন বুলবুল, আউলাদ, আছরাফ আহমেদ শিপন, নজরুল ইসলাম, অলিউল্লাহ ওরফে ওলিউর রহমান, খুরশেদ আলম, বাছিদ ওরফে আবদুল বাছিদ, আবদুস সালাম, ইমতিয়াজ রফিক চৌধুরী, আবদুল্লাহ ফারুক, কয়েছ ওরফে কয়েছুজ্জামান তালুকদার, আবু রেহান, রুবেল ও জ্যোতির্ময় দাস সৌরভ।
তদন্ত পর্যালোচনায় আরও বলা হয়েছে, ছাত্রাবাসে আগুন দেয়ার সময় গ্যালনের পেট্রোল ব্যবহার করা হয়। পরে ছাত্রাবাসের কক্ষগুলোতে লুটপাটও হয়। এক সাক্ষীর বরাত দিয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছাত্রাবাস যখন আগুনে পুড়ছিল, তখন পুলিশের সামনেই মিছিল করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তাদের হাতে তখন রামদা ছিল। পুলিশের সামনে এমন ঘটনা ঘটলেও তারা ছিল নীরব। ওই সমাবেশে এমসি কলেজের ছাত্র পংকজ পুরকায়স্থ (তখন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি) বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন, স্বাধীনতার পর এই প্রথম শিবিরকে হোস্টেল থেকে তাড়ালাম।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বহুল আলোচিত এ মামলার রহস্য উদঘাটন করতে আদালতের নির্দেশে প্রথমে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় সিআইডিকে। এরপর সিআইডি ২০১৩ সালের ৩১ অক্টোবর আদালতে প্রথমবার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। আদালত প্রতিবেদন গ্রহণ না করে পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেন। এরপর ২০১৫ সালের ৯ আগস্ট ফের আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয় সিআইডি। ওই প্রতিবেদনও আদালত প্রত্যাখ্যান করে। তৃতীয় দফায় ঘটনাটি তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় পিবিআইকে। কিন্তু পিবিআইয়ের তদন্তেও অপরাধীরা চিহ্নিত হয়নি। সর্বশেষ ৩১ মে বিচার বিভাগীয় তদন্তের আদেশ দেন সিলেটের অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট উম্মে সরাবন তহুরা। প্রায় ৫ মাস তদন্তের পর ২৯ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে বিচার বিভাগীয় কমিটি।
প্রসঙ্গত, ছাত্রশিবির ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষের জের ধরে ২০১২ সালের ৮ জুলাই এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে আগুন দেয়া হয়। আগুনে ৪২টি কক্ষ পুড়ে যায়, লুটপাট করা হয়। এ ঘটনায় হল সুপার বশির আহমদ বাদী হয়ে সিলেট মহানগর পুলিশের শাহপরান থানায় ২০১২ সালের ১৩ জুলাই মামলা করেন। পরে এ ঘটনায় আরও দুটি মামলা হয়। এ ঘটনার পর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে অগ্নিসংযোগকারীদের শনাক্ত করার নির্দেশ দেন। তারা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়া যাবে না।