কাসেম সোলেমানিকে হত্যায় মধ্যপ্রাচ্যে ফের যুদ্ধের দামামা
মধ্যপ্রাচ্যে ইতিমধ্যে বিপজ্জনক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। প্রচণ্ড সংঘাতে উত্তপ্ত সিরিয়া, ইয়েমেন ও ফিলিস্তিন। এর মধ্যে ইরানের অন্যতম ক্ষমতাধর ব্যক্তি, সমর প্রকৌশলবিদ ও সেনা কমান্ডার জেনারেল কাসেম সোলেমানি ও ইরাকের মিলিশিয়া বাহিনী শীর্ষ নেতা আবু মাহদি আল মুহানদিসের হত্যা সেই উত্তেজনার আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে।
বাজতে শুরু করেছে আরেক যুদ্ধ-সংঘাতের দামামা। সেই সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যের গণ্ডি পেরিয়ে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ২০০৩ সালে মার্কিন আগ্রাসনের দেড় দশক পর ইরাকের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এলেও দেশটি ফের আঞ্চলিক সংঘাতের কেন্দ্রে চলে এসেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সোলেমানির হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের চিত্র মুহূর্তেই পাল্টে গেল। এ হত্যাকাণ্ড ট্রাম্পকে স্বস্তি দিলেও মধ্যপ্রাচ্যে রক্ত ঝরাবে। সম্প্রতি মার্কিন কর্মকর্তারা বারবার অভিযোগ তুলেছেন, তেহরান সমর্থিত ইরাকি মিলিশিয়া বাহিনী ইরাকে মার্কিন সেনাদের ওপর রকেট হামলা চালাচ্ছে।
গত মাসের শেষ দিকে (২৭ ডিসেম্বর) কে বা কারা রকেট হামলা চালিয়ে উত্তর ইরাকে কর্মরত এক মার্কিন ঠিকাদারকে হত্যা করে। ওই হামলা ইরানপন্থীদের ‘কাজ’ বলে হাশদ আস সাবির কয়েকটি ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালিয়ে ২৫ যোদ্ধাকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র।
ক্ষুব্ধ হাশদ সমর্থকরা বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসে হামলা চালায়। দূতাবাস হামলার জন্যও তেহরানকে দোষারোপ করে ‘চড়া মূল্য দিতে হবে’ হুমকি দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এরপরই ট্রাম্পের নির্দেশে হত্যা করা হল কাসেম সোলাইমানিকে। শুক্রবার ইরাকের রাজধানী বাগদাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবেশ পথে সোলেমানি ও তার শীর্ষ উপদেষ্টা ইরাকের মিলিশিয়া বাহিনী হাশদ আস সাবি ফোর্সের প্রধান আবু মাহদি আল মুহানদিসকে বহনকারী দুটি গাড়িতে রকেট হামলা চালায় মার্কিন বিমানবাহিনী।
হামলার পরই টুইট করে মার্কিন জাতীয় পতাকার ছবি পোস্ট করেন ট্রাম্প। রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে হামলার দায় স্বীকার করে মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ। এক বিবৃতিতে পেন্টাগন দাবি করে, ‘ভবিষ্যতে ইরান যেন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে কোনো হামলার পরিকল্পনা করতে না পারে সেজন্য প্রতিরক্ষামূলক এ হামলা চালানো হয়েছে।’
সোলেমানি হত্যায় মার্কিন কংগ্রেস এখন বিভক্ত। ট্রাম্পের মিত্র রিপাবলিকানরা এ পদক্ষেপের প্রশংসা করে বলেছে, এতে করে ইরানকে কঠিন বার্তা দেয়া হয়েছে। তবে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম বলেন, যে হাতে মার্কিনিদের রক্ত ঝরেছে, তার মৃত্যু ইরানি শাসনের ওপর একটি বড় আঘাত।
ডেমোক্র্যাটরা সমালোচনা করে বলেছেন, ট্রাম্পের ঔদ্ধত্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত আরেকটি মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে। তারা মনে করছে এতে করে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠবে।
বেড়ে যাবে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সৈন্য ও তাদের পেছনে ব্যয়। সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স বলেন, ট্রাম্পের এমন বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত আমাদের আরেকটি মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এতে করে অনেক প্রাণ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। খরচ হবে কোটি কোটি ডলার। ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এ অসীম যুদ্ধ শেষ করবেন। কিন্তু তার এ পদক্ষেপ তার পরিপন্থী।
ডেমোক্র্যাটদের দাবি, এ হামলা চালানোর এখতিয়ার প্রেসিডেন্টের নেই। সেজন্য তার কংগ্রেসের অনুমতির প্রয়োজন ছিল। সিনেটর ক্রিস মারফি বলেন, ‘সোলেমানি নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু ছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র কি কোনো অনুমতি নিয়ে হামলা চালিয়েছে।
ইরানের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর এ ব্যক্তির ওপর এমন হামলায় আঞ্চলিক যুদ্ধ শুরুর শঙ্কা অনেক বেশি।’ এটা জেনেও কেন কংগ্রেসের অনুমতি নেয়া হল না সেই প্রশ্ন তোলেন তিনি। বিশ্লেষকরাও বলছেন, আরেকটি ব্যাপক সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানি নীতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ চার্লস লিস্টার বলেন, ‘কৌশলগত গুরুত্ব ও প্রভাবের দিক দিয়ে সোলেমানি হত্যাকাণ্ড আলকায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেন কিংবা আইএস নেতা আবুবকর আল বাগদাদি হত্যাকে ম্লান করে দিয়েছে।
গত কয়েক মাস ধরে ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যে বিপজ্জনক উত্তেজনা বিরাজ করছে। ইরানের শীর্ষ সামরিক ব্যক্তিত্বের হত্যাকাণ্ডে সেই উত্তেজনা তুঙ্গে পৌঁছেছে।’
সোলেমানির হত্যায় ইতিমধ্যে প্রতিশোধের হুংকার দিয়েছে তেহরান। ‘ভয়াবহ প্রতিশোধ’ নেয়া হবে বলে হুশিয়ারি দিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। হত্যাকাণ্ডকে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদে আখ্যা দিয়ে দেশটিকে এর ফল ভুগতে হবে হুমকি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। ইরাক-ইরানে উপস্থিত মার্কিন নাগরিকদের দ্রুত আকাশপথে দেশ ছাড়তে বলে বিবৃতি দিয়েছে বাগদাদে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস।